- readaim.com
- 0

উত্তর::ভূমিকা:- মিশরীয় সভ্যতা ছিল বিশ্বের প্রাচীন ও উন্নত সভ্যতাগুলোর মধ্যে একটি। নীল নদের তীরে গড়ে ওঠা এই সভ্যতা প্রায় তিন হাজার বছর ধরে টিকে ছিল। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে এর পতন শুরু হয়। বহিঃশত্রুর আক্রমণ, অভ্যন্তরীণ সংঘাত, অর্থনৈতিক সংকট এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগ এই সভ্যতার পতনের মূল কারণ হয়ে দাঁড়ায়। আজ আমরা মিশরীয় সভ্যতার পতনের পাঁচটি প্রধান কারণ নিয়ে আলোচনা করব।
১।বহিঃশত্রুর আক্রমণ:- মিশরীয় সভ্যতার পতনের একটি বড় কারণ ছিল বহিঃশত্রুর ক্রমাগত আক্রমণ। হিকসোস, আসিরিয়ান, পারসিয়ান এবং গ্রিকদের মতো শক্তিশালী শত্রুরা মিশর আক্রমণ করে। বিশেষ করে খ্রিস্টপূর্ব ১৫০০ সালে হিকসোসরা মিশরের উত্তরাংশ দখল করে নেয়। পরবর্তীতে খ্রিস্টপূর্ব ৩৩২ সালে আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট মিশর জয় করেন। এসব আক্রমণ মিশরের রাজনৈতিক ও সামরিক শক্তিকে দুর্বল করে দেয়।
২।অভ্যন্তরীণ কোন্দল ও শাসনব্যবস্থার দুর্বলতা:- মিশরের পতনের আরেকটি কারণ ছিল অভ্যন্তরীণ কোন্দল ও শাসকদের অদক্ষতা। ফারাওদের মধ্যে ক্ষমতার লড়াই এবং আমলাতন্ত্রের দুর্নীতি শাসনব্যবস্থাকে দুর্বল করে দেয়। খ্রিস্টপূর্ব ১১৮০ সালের দিকে রামেসেস III-এর শাসনামলে শ্রমিকদের বিদ্রোহ দেখা দেয়, যা অর্থনীতিকে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে। শাসকদের মধ্যে ঐক্যের অভাব মিশরকে ধীরে ধীরে পতনের দিকে নিয়ে যায়।
৩।অর্থনৈতিক সংকট ও সম্পদের অপব্যবহার:- মিশরীয় সভ্যতার পতনের পেছনে অর্থনৈতিক সংকটও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বিশাল পিরামিড ও মন্দির নির্মাণে অত্যধিক সম্পদ ব্যয় করা হয়। খ্রিস্টপূর্ব ১০৭০ সালের দিকে মিশরের অর্থনীতি দুর্বল হয়ে পড়ে। কৃষি উৎপাদন কমে যাওয়া এবং বাণিজ্য পথে সমস্যা সৃষ্টি হওয়ায় দেশটির আয় drastically কমে যায়। এই সংকট মিশরকে দ্রুত পতনের দিকে ঠেলে দেয়।
৪।প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও পরিবেশগত পরিবর্তন:- মিশরের পতনে প্রাকৃতিক দুর্যোগও ভূমিকা রেখেছে। নীল নদের বন্যা কমে যাওয়া এবং খরার কারণে কৃষি উৎপাদন হ্রাস পায়। গবেষণায় দেখা গেছে, খ্রিস্টপূর্ব ২২০০ সালের দিকে একটি ভয়াবহ খরা মিশরকে আঘাত করে। এছাড়া মরুভূমির সম্প্রসারণ ও মাটির উর্বরতা হ্রাস মিশরীয় কৃষিকে ধ্বংস করে দেয়। পরিবেশগত এই পরিবর্তন মিশরের স্থায়িত্বকে হুমকির মুখে ফেলে।
৫. ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক পরিবর্তন:- মিশরের পতনের পেছনে ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক পরিবর্তনও দায়ী। ফারাও আখেনাতেনের আমলে একেশ্বরবাদের প্রচলন মিশরীয়দের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করে। পরবর্তীতে খ্রিস্টান ও ইসলামের প্রসার মিশরের প্রাচীন ধর্ম ও সংস্কৃতিকে দুর্বল করে দেয়। রোমান শাসনামলে (খ্রিস্টপূর্ব ৩০ সাল থেকে) মিশরের স্বাধীন সংস্কৃতি ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হতে থাকে। এই পরিবর্তন মিশরীয় সভ্যতার পতনকে ত্বরান্বিত করে।
৬।প্রযুক্তিগত ও বৈজ্ঞানিক স্থবিরতা:- মিশরীয়রা প্রাথমিকভাবে প্রযুক্তি ও বিজ্ঞানে অগ্রগামী ছিল, কিন্তু সময়ের সাথে সাথে তাদের উদ্ভাবনী শক্তি হ্রাস পায়। প্রতিবেশী সভ্যতাগুলো যেমন গ্রিক ও রোমানরা নতুন প্রযুক্তি ও যুদ্ধকৌশল আয়ত্ত করলেও মিশরীয়রা পুরনো পদ্ধতিতে আটকে থাকে। উদাহরণস্বরূপ, লোহার ব্যবহার মিশরে ধীরগতিতে ছড়ায়, যখন অন্যান্য সভ্যতা খ্রিস্টপূর্ব ১২০০ সাল নাগাদ এটি ব্যাপকভাবে ব্যবহার শুরু করে। এই প্রযুক্তিগত পিছিয়ে পড়া মিশরকে সামরিক ও অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল করে তোলে।
৭।জনসংখ্যা হ্রাস ও শ্রমশক্তির সংকট:- মিশরীয় সভ্যতার পতনের আরেকটি কারণ ছিল জনসংখ্যা হ্রাস। যুদ্ধ, মহামারী ও দুর্ভিক্ষের কারণে মিশরের জনসংখ্যা ক্রমাগত কমতে থাকে। ইতিহাসবিদরা অনুমান করেন যে, খ্রিস্টপূর্ব ১২০০ থেকে ১০০০ সালের মধ্যে মিশরের জনসংখ্যা প্রায় ৩০% কমে যায়। শ্রমিকের অভাবে কৃষি ও নির্মাণ কাজ ব্যাহত হয়, যা অর্থনীতিকে আরও দুর্বল করে দেয়। এই জনসংখ্যা সংকট মিশরের সামাজিক কাঠামোকে ধ্বংস করে দেয়।
৮।বাণিজ্য পথের পরিবর্তন ও অর্থনৈতিক অবনতি:- প্রাচীন বিশ্বে মিশর ছিল বাণিজ্যের কেন্দ্রস্থল, কিন্তু সময়ের সাথে সাথে বাণিজ্য পথ পরিবর্তিত হয়। ফিনিশিয়ান ও গ্রিক নাবিকরা নতুন সমুদ্রপথ আবিষ্কার করায় মিশরের ঐতিহ্যবাহী বাণিজ্য কমতে থাকে। খ্রিস্টপূর্ব ৬০০ সালের দিকে মিশরের রপ্তানি আয় ৪০% পর্যন্ত হ্রাস পায়। এই অর্থনৈতিক অবনতি রাজকোষকে ফাঁকা করে দেয় এবং সাম্রাজ্যের স্থায়িত্বকে হুমকির মুখে ফেলে।
৯।প্রশাসনিক অদক্ষতা ও আমলাতান্ত্রিক জটিলতা:- মিশরের প্রশাসনিক ব্যবস্থা একসময় সুসংগঠিত ছিল, কিন্তু পরবর্তীতে এটি জটিল ও দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়ে। স্থানীয় গভর্নররা কেন্দ্রীয় শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ শুরু করে এবং কর ফাঁকি দেওয়ার প্রবণতা বাড়ে। প্যাপিরাস রেকর্ড থেকে জানা যায় যে, খ্রিস্টপূর্ব ১১০০ সালের দিকে সরকারি কর্মকর্তাদের দুর্নীতি এতটাই বেড়ে যায় যে, রাজস্ব আদায় প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। এই অদক্ষ প্রশাসন মিশরকে ধীরে ধীরে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যায়।
১০।সামাজিক বৈষম্য ও শ্রেণীসংঘাত:- মিশরীয় সমাজে ধর্মীয় নেতা, অভিজাত ও সাধারণ মানুষের মধ্যে বিশাল বৈষম্য ছিল। ফারাও ও পুরোহিত শ্রেণী সম্পদের পাহাড় গড়ে তুললেও কৃষক ও শ্রমিকরা চরম দারিদ্র্যে ভুগত। খ্রিস্টপূর্ব ১১৫০ সালের দিকে নিম্নবর্গীয় মানুষের মধ্যে বিদ্রোহ দেখা দেয়, যা সাম্রাজ্যের স্থিতিশীলতা নষ্ট করে। এই সামাজিক অস্থিরতা মিশরীয় সভ্যতাকে ভেতর থেকে দুর্বল করে দেয়।
উপসংহার:- মিশরীয় সভ্যতার পতন কোনো একক কারণে ঘটেনি। বহিঃশত্রুর আক্রমণ, অভ্যন্তরীণ কোন্দল, অর্থনৈতিক সংকট, প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং সাংস্কৃতিক পরিবর্তন—এ সবকিছু মিলেই এই মহান সভ্যতার অবসান ঘটায়। মিশরীয় সভ্যতা যদিও বিলুপ্ত হয়েছে, তার অবদান ইতিহাসে আজও স্বর্ণাক্ষরে লেখা রয়েছে।
🏹 বহিঃশত্রুর আক্রমণ
⚔️ অভ্যন্তরীণ কোন্দল ও শাসনব্যবস্থার দুর্বলতা
💰 অর্থনৈতিক সংকট ও সম্পদের অপব্যবহার
🌾 প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও পরিবেশগত পরিবর্তন
🕊️ ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক পরিবর্তন
⚙️ প্রযুক্তিগত ও বৈজ্ঞানিক স্থবিরতা
📉 জনসংখ্যা হ্রাস ও শ্রমশক্তির সংকট
🚢 বাণিজ্য পথের পরিবর্তন ও অর্থনৈতিক অবনতি
📜 প্রশাসনিক অদক্ষতা ও আমলাতান্ত্রিক জটিলতা
⚖️ সামাজিক বৈষম্য ও শ্রেণীসংঘাত
মিশরীয় সভ্যতার পতন ধীরে ধীরে ঘটে। খ্রিস্টপূর্ব ১০৭০ সালে নিউ কিংডমের পতনের পর মিশর দুর্বল হতে থাকে। ৩৩২ খ্রিস্টপূর্বাব্দে আলেকজান্ডারের বিজয় এবং ৩০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে রোমানদের দখলের মাধ্যমে মিশর স্বাধীনতা হারায়। ব্রিটিশ মিউজিয়ামের গবেষণা অনুযায়ী, মিশরের ৬০% পুরাকীর্তি বিভিন্ন আক্রমণ ও লুটের শিকার হয়। প্রাচীন এই সভ্যতা তার জ্ঞান, স্থাপত্য ও সংস্কৃতি দিয়ে বিশ্বকে আজও অনুপ্রাণিত করে।