- readaim.com
- 0
উত্তর::ভূমিকা: অর্থনীতিতে মুদ্রাস্ফীতি ও মুদ্রাসংকোচন দুটি বিপরীতমুখী ও গুরুত্বপূর্ণ ধারণা। সহজ ভাষায়, এই দুটি অবস্থা কোনো দেশের বাজারে পণ্যের দামের ওঠানামাকে নির্দেশ করে, যা সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা ও জীবনযাত্রার মানকে সরাসরি প্রভাবিত করে। এই নিবন্ধে আমরা এই দুটি বিষয়ের তুলনামূলক আলোচনা করব।
১।মূল ধারণা: মুদ্রাস্ফীতি হলো এমন একটি অর্থনৈতিক অবস্থা যখন বাজারে পণ্য ও সেবার সাধারণ মূল্যস্তর ক্রমাগত বৃদ্ধি পায়। এর ফলে নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা দিয়ে আগের চেয়ে কম জিনিস কেনা যায়, অর্থাৎ টাকার ক্রয়ক্ষমতা কমে যায়। অন্যদিকে, মুদ্রাসংকোচন এর বিপরীত, যখন পণ্য ও সেবার মূল্যস্তর ক্রমাগত হ্রাস পায়। এর ফলে টাকার ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি পায় এবং নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা দিয়ে আগের চেয়ে বেশি জিনিস কেনা যায়। এই দুটি ধারণাই অর্থনীতির গতিপ্রকৃতি বোঝার জন্য অত্যন্ত জরুরি।
২।কারণ: মুদ্রাস্ফীতির প্রধান কারণ হলো বাজারে টাকার সরবরাহ বৃদ্ধি বা পণ্যের চাহিদা বেশি হওয়া। যখন মানুষের হাতে বেশি টাকা থাকে, তখন তারা বেশি খরচ করে, যা দাম বাড়িয়ে দেয়। আবার, উৎপাদন খরচ বৃদ্ধিও এর একটি কারণ হতে পারে। অপরদিকে, মুদ্রাসংকোচনের মূল কারণ হলো বাজারে টাকার সরবরাহ কমে যাওয়া বা চাহিদা হ্রাস পাওয়া। যখন মানুষ খরচ করতে চায় না বা তাদের কাছে পর্যাপ্ত টাকা থাকে না, তখন বিক্রেতারা তাদের পণ্য বিক্রি করার জন্য দাম কমিয়ে দেয়।
৩।প্রভাব: মুদ্রাস্ফীতি সাধারণ মানুষের সঞ্চয়কে ক্ষয় করে এবং নির্দিষ্ট আয়ের মানুষদের জন্য সমস্যা তৈরি করে। এটি ঋণদাতাদের জন্য খারাপ, কারণ তারা যে টাকা ফেরত পায় তার প্রকৃত মূল্য কমে যায়। তবে, এটি ঋণগ্রহীতাদের জন্য সুবিধাজনক। বিপরীতভাবে, মুদ্রাসংকোচন সাধারণ মানুষের সঞ্চয়ের মূল্য বাড়িয়ে দেয়, কিন্তু এটি শিল্প উৎপাদন ও বিনিয়োগকে নিরুৎসাহিত করে। কারণ, দাম কমার আশায় মানুষ কেনাকাটা স্থগিত করে, যা অর্থনৈতিক মন্দা সৃষ্টি করতে পারে।
৪।সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভূমিকা: মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সরকার সাধারণত কর বাড়ানো বা সরকারি ব্যয় কমানোর মতো আর্থিক নীতি গ্রহণ করে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুদের হার বাড়িয়ে বাজারে টাকার সরবরাহ কমানোর চেষ্টা করে। মুদ্রাসংকোচনের ক্ষেত্রে, সরকার কর কমানো বা সরকারি ব্যয় বাড়ানোর মাধ্যমে জনগণের হাতে টাকা বাড়াতে চেষ্টা করে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুদের হার কমিয়ে ঋণ গ্রহণকে উৎসাহিত করে এবং বাজারে টাকার সরবরাহ বাড়ায়।
৫।অর্থনৈতিক কার্যকলাপ: মধ্যম মাত্রার মুদ্রাস্ফীতি সাধারণত অর্থনীতির জন্য উপকারী হতে পারে, কারণ এটি বিনিয়োগ ও উৎপাদনকে উৎসাহিত করে। এটি শ্রমিকদের মজুরি বাড়াতে সাহায্য করে এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বজায় রাখে। কিন্তু মুদ্রাসংকোচন প্রায়শই অর্থনীতির জন্য ক্ষতিকর, কারণ এটি বিনিয়োগকে নিরুৎসাহিত করে, উৎপাদন বন্ধ করে দেয় এবং বেকারত্ব বাড়িয়ে দেয়। এর ফলে একটি মন্দা বা সংকট তৈরি হতে পারে।
৬।উদাহরণ: ধরা যাক, গত বছর ১ কেজি চালের দাম ছিল ৫০ টাকা, কিন্তু এই বছর তা বেড়ে ৬০ টাকা হয়েছে। এটি মুদ্রাস্ফীতির একটি উদাহরণ। এর ফলে, ৫০ টাকা দিয়ে এখন আর ১ কেজি চাল কেনা সম্ভব নয়। অন্যদিকে, যদি ১ কেজি আপেলের দাম ১০০ টাকা থেকে কমে ৮০ টাকা হয়, তবে এটি মুদ্রাসংকোচনের উদাহরণ। এখন ১০০ টাকা দিয়ে ১ কেজির বেশি আপেল কেনা সম্ভব। এই উদাহরণ দুটি সাধারণ মানুষের জীবনে এই দুটি ধারণার প্রভাব সহজে ফুটিয়ে তোলে।
৭।ক্রেতা এবং বিক্রেতা: মুদ্রাস্ফীতির সময়ে ক্রেতারা ক্ষতিগ্রস্ত হয় কারণ তাদের ক্রয়ক্ষমতা কমে যায়। তবে, বিক্রেতারা লাভবান হতে পারে, কারণ তারা বেশি দামে পণ্য বিক্রি করে। মুদ্রাসংকোচনের সময়ে ক্রেতারা লাভবান হয়, কারণ তারা কম দামে পণ্য পায়। কিন্তু বিক্রেতারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়, কারণ তাদের পণ্যের দাম কমে যায় এবং মুনাফা কমে যায়। এর ফলে নতুন বিনিয়োগ ও উৎপাদন কমে যেতে পারে, যা সামগ্রিক অর্থনীতির জন্য মন্দা ডেকে আনে।
৮।বেকারত্ব: মুদ্রাস্ফীতির কারণে যখন অর্থনৈতিক কার্যকলাপ বৃদ্ধি পায়, তখন নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয় এবং বেকারত্ব হ্রাস পেতে পারে। তবে, অতিরিক্ত মুদ্রাস্ফীতি হলে ব্যবসায়িক অনিশ্চয়তা বেড়ে যায়। মুদ্রাসংকোচন প্রায়শই বেকারত্ব বৃদ্ধি করে। যখন পণ্যের দাম কমে যায় এবং লাভ কমে যায়, তখন অনেক কোম্পানি উৎপাদন কমিয়ে দেয় বা কর্মী ছাঁটাই করে, যা বেকারত্বের হার বাড়িয়ে দেয়।
৯।বিনিময় হার: উচ্চ মুদ্রাস্ফীতি সাধারণত কোনো দেশের মুদ্রার বিনিময় হারকে দুর্বল করে তোলে। এর ফলে সেই দেশের মুদ্রার মান অন্যান্য মুদ্রার তুলনায় কমে যায়। অন্যদিকে, মুদ্রাসংকোচন কোনো দেশের মুদ্রার বিনিময় হারকে শক্তিশালী করে। কিন্তু এটি রপ্তানিকে কঠিন করে তোলে, কারণ বিদেশি ক্রেতাদের জন্য সেই দেশের পণ্য আরও ব্যয়বহুল হয়ে যায়।
১০।সঞ্চয় ও বিনিয়োগ: মুদ্রাস্ফীতির সময়ে সঞ্চয়ের মূল্য কমে যাওয়ায় মানুষ সঞ্চয় করতে নিরুৎসাহিত হয় এবং দ্রুত খরচ করতে চায়। এটি বিনিয়োগের জন্য তহবিল সরবরাহ কমিয়ে দিতে পারে। মুদ্রাসংকোচনের সময় মানুষ খরচ না করে ভবিষ্যতের জন্য সঞ্চয় করে, কারণ তারা আশা করে পণ্যের দাম আরও কমবে। এটি অর্থনীতির বিনিয়োগ প্রবাহকে বাধাগ্রস্ত করে এবং উৎপাদনকে কমিয়ে দেয়।
১১।অর্থনৈতিক ভারসাম্য: একটি স্থিতিশীল অর্থনীতিতে সাধারণত একটি নির্দিষ্ট, স্বল্প ও নিয়ন্ত্রিত মুদ্রাস্ফীতির হার থাকে, যা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সহায়ক। অতিরিক্ত মুদ্রাস্ফীতি বা মুদ্রাসংকোচন উভয়ই অর্থনীতির জন্য ক্ষতিকর। মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে গেলে Hyperinflation হতে পারে, যেমনটি জিম্বাবোয়েতে হয়েছিল। মুদ্রাসংকোচন গভীর মন্দা সৃষ্টি করে, যেমন ১৯২৯ সালের মহামন্দা।
১২।আর্থিক নীতি: মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক সাধারণত কঠোর আর্থিক নীতি গ্রহণ করে, যেমন সুদের হার বৃদ্ধি করা। এতে ঋণ নেওয়া কঠিন হয় এবং বাজারে টাকার সরবরাহ কমে যায়। মুদ্রাসংকোচন মোকাবিলায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক শিথিল আর্থিক নীতি গ্রহণ করে, যেমন সুদের হার কমানো। এতে ঋণ নেওয়া সহজ হয় এবং বাজারে টাকার সরবরাহ বাড়ে।
১৩।ঋণ ও দেনাদার: মুদ্রাস্ফীতির সময়ে দেনাদাররা লাভবান হয়, কারণ তারা যে টাকা ঋণ নিয়েছিল, তার প্রকৃত মূল্য এখন কম। অর্থাৎ, তারা কম মূল্যের টাকা ফেরত দেয়। এর ফলে ঋণের বোঝা কমে যায়। মুদ্রাসংকোচনের সময়, দেনাদাররা ক্ষতিগ্রস্ত হয়, কারণ যে টাকা তারা ফেরত দিচ্ছে, তার প্রকৃত মূল্য তারা যে টাকা নিয়েছিল তার চেয়ে বেশি।
১৪।সরকার ও রাজস্ব নীতি: মুদ্রাস্ফীতির কারণে সরকার কর থেকে বেশি রাজস্ব পেতে পারে, কারণ মানুষের আয় ও পণ্যের দাম উভয়ই বাড়ে। কিন্তু একই সাথে সরকারি ব্যয়ের পরিমাণও বেড়ে যায়। মুদ্রাসংকোচনের কারণে সরকারের কর থেকে আয় কমে যায়, কারণ মানুষের আয় কমে যায় এবং পণ্যের দামও কমে যায়, যা রাজস্ব ঘাটতি সৃষ্টি করতে পারে।
১৫।মূল্যস্ফীতির কারণ: চাহিদাজনিত মুদ্রাস্ফীতি ঘটে যখন বাজারে পণ্যের চাহিদা তার সরবরাহের চেয়ে বেশি হয়। সরবরাহজনিত মুদ্রাস্ফীতি ঘটে যখন উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি পায়, যেমন কাঁচামালের দাম বা শ্রমিকের মজুরি বাড়লে। মুদ্রাসংকোচনের মূল কারণ হলো চাহিদা কমে যাওয়া এবং উৎপাদন বৃদ্ধি পাওয়া। এর ফলে বাজারে সরবরাহ বেশি থাকে কিন্তু ক্রেতা কম থাকে।
১৬।সামাজিক প্রভাব: উচ্চ মুদ্রাস্ফীতি সাধারণ মানুষের মধ্যে অসন্তোষ ও অস্থিরতা তৈরি করতে পারে, কারণ তাদের জীবনযাত্রার ব্যয় হঠাৎ করে বেড়ে যায়। এটি সমাজে আয়ের বৈষম্য বাড়াতে পারে। মুদ্রাসংকোচনও সামাজিক অস্থিরতা তৈরি করে, কারণ এটি বেকারত্ব এবং ব্যবসায়িক সংকট বাড়িয়ে দেয়, যা হতাশা ও অনিশ্চয়তা সৃষ্টি করে।
১৭।ঐতিহাসিক উদাহরণ: মুদ্রাস্ফীতির ঐতিহাসিক উদাহরণ হিসেবে ১৯২০-এর দশকের জার্মানিতে Hyperinflation উল্লেখযোগ্য, যেখানে মুদ্রার মূল্য দ্রুত হ্রাস পেয়েছিল। অন্যদিকে, ১৯২৯ সালের মহামন্দার সময়কার গভীর মুদ্রাসংকোচন অর্থনীতির উপর ভয়াবহ প্রভাব ফেলেছিল, যা বিশ্বব্যাপী বেকারত্ব ও দারিদ্র্য বৃদ্ধি করেছিল। এই দুটি ঘটনাই দেখায় যে, চরম মুদ্রাস্ফীতি বা মুদ্রাসংকোচন উভয়ই অর্থনীতির জন্য কতটা বিপজ্জনক।
উপসংহার: মুদ্রাস্ফীতি ও মুদ্রাসংকোচন উভয়ই অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ সূচক। একটি নিয়ন্ত্রিত মাত্রার মুদ্রাস্ফীতি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য সহায়ক হলেও, অতিরিক্ত মুদ্রাস্ফীতি বা মুদ্রাসংকোচন উভয়ই অর্থনীতিতে বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। তাই, সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উচিত সতর্ক আর্থিক ও রাজস্ব নীতির মাধ্যমে এই দুটি অবস্থার মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখা, যাতে একটি স্থিতিশীল ও সুষম অর্থনৈতিক পরিবেশ নিশ্চিত করা যায়।
🟢 ১। মূল ধারণা 🟠 ২। কারণ 🔴 ৩। প্রভাব 🔵 ৪। সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভূমিকা 🟣 ৫। অর্থনৈতিক কার্যকলাপ 🟡 ৬। উদাহরণ 🟢 ৭। ক্রেতা এবং বিক্রেতা 🟠 ৮। বেকারত্ব 🔴 ৯। বিনিময় হার 🔵 ১০। সঞ্চয় ও বিনিয়োগ 🟣 ১১। অর্থনৈতিক ভারসাম্য 🟡 ১২। আর্থিক নীতি 🟢 ১৩। ঋণ ও দেনাদার 🟠 ১৪। সরকার ও রাজস্ব নীতি 🔴 ১৫। মূল্যস্ফীতির কারণ 🔵 ১৬। সামাজিক প্রভাব 🟣 ১৭। ঐতিহাসিক উদাহরণ।
ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে মুদ্রাস্ফীতি ও মুদ্রাসংকোচনের একাধিক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটেছে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯২৩ সালে জার্মানিতে Hyperinflation হয়েছিল, যখন একটি রুটির দাম ছিল কয়েক বিলিয়ন মার্ক। এই চরম মুদ্রাস্ফীতি দেশের অর্থনৈতিক কাঠামো সম্পূর্ণ ভেঙে দিয়েছিল। অপরদিকে, ১৯২৯ সালে শুরু হওয়া মহামন্দা (Great Depression) ছিল বিশ্ব অর্থনীতির ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহ মুদ্রাসংকোচনের একটি উদাহরণ। এই সময় পণ্যের দাম এবং উৎপাদন নাটকীয়ভাবে কমে গিয়েছিল, যা বিশ্বজুড়ে ব্যাপক বেকারত্ব ও দারিদ্র্যের কারণ হয়। সাম্প্রতিক সময়ে, ২০০৮ সালের বিশ্ব অর্থনৈতিক সংকটের পর অনেক উন্নত দেশে মুদ্রাসংকোচনের ঝুঁকি দেখা গিয়েছিল, যেখানে কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো সুদের হার প্রায় শূন্য করে দিয়েছিল। এই ঘটনাগুলো প্রমাণ করে যে, মুদ্রাস্ফীতি বা মুদ্রাসংকোচন উভয়ই সমাজের জন্য মারাত্মক হুমকি হতে পারে।

