- readaim.com
- 0

উত্তর:প্রাককথা:-সম্পত্তি, যা এককালে কেবল টিকে থাকার হাতিয়ার ছিল, সময়ের সাথে সাথে জটিল সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক কাঠামোর কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। ব্যক্তিগত অধিকার, বাজারের উত্থান এবং আইনি কাঠামোর বিবর্তনের মাধ্যমে সম্পত্তির ধারণা আজকের রূপে বিকশিত হয়েছে। এই বিবর্তন কেবল বস্তুগত সম্পদের মালিকানার পরিবর্তন নয়, বরং মানুষের পারস্পরিক সম্পর্ক এবং সমাজের মূলনীতির পরিবর্তনকেও প্রতিফলিত করে। আসুন, সম্পত্তির বিবর্তনের এই দীর্ঘ এবং আকর্ষণীয় যাত্রাটি বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা যাক।
১. আদিম সমাজে সম্পত্তির ধারণা (প্রাচীনকাল): মানব ইতিহাসের শুরুতে সম্পত্তির ধারণা ব্যক্তিগত মালিকানার চেয়ে গোষ্ঠীভিত্তিক ছিল। শিকার করা পশু বা ফলমূল গোষ্ঠীর সকলে মিলে ভাগ করে নিত। যাযাবর জীবনে ভূমির উপর ব্যক্তিগত অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়নি, বরং গোষ্ঠীর অধীনে প্রাকৃতিক সম্পদের ব্যবহার চলত। কোনো নির্দিষ্ট ভূখণ্ডে স্থায়ী বসবাস না থাকায় ব্যক্তিগত সম্পত্তির ধারণাও তেমন একটা বিকাশ লাভ করেনি।
২. কৃষিভিত্তিক সমাজে পরিবর্তন (নবোপলীয় বিপ্লব): কৃষির উদ্ভাবনের ফলে মানুষ স্থায়ী বসতি স্থাপন করতে শুরু করে। এর ফলস্বরূপ জমির গুরুত্ব বৃদ্ধি পায় এবং ব্যক্তিগত মালিকানার ধারণা ধীরে ধীরে স্পষ্ট হতে থাকে। পরিবারভিত্তিক চাষাবাদ জমির উপর বংশানুক্রমিক অধিকারের জন্ম দেয়। উদ্বৃত্ত ফসল এবং পশুসম্পদ ব্যক্তিগত সম্পত্তিতে পরিণত হয়, যা সামাজিক স্তরবিন্যাসের সূচনা করে।
৩. সামন্তবাদের উত্থান (মধ্যযুগ): মধ্যযুগে সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থায় ভূমি ছিল ক্ষমতার মূল উৎস। রাজা বা অভিজাত শ্রেণির লোকেরা জমির মালিকানা লাভ করত এবং কৃষকরা তাদের অধীনে কাজ করত। কৃষকদের জমির উপর ব্যক্তিগত মালিকানা ছিল না, তারা সামন্ত প্রভুদের জমিতে শ্রম দিত এবং বিনিময়ে সুরক্ষা ও কিছু সুবিধা পেত। এই সময়ে সম্পত্তির অধিকার মূলত সামাজিক অবস্থানের উপর নির্ভরশীল ছিল।
৪. বণিকবাদের প্রভাব (ষোড়শ-অষ্টাদশ শতাব্দী): বাণিজ্য প্রসারের সাথে সাথে সম্পত্তির ধারণায় নতুন মাত্রা যোগ হয়। ভূমি ছাড়াও পণ্য, জাহাজ এবং বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের মালিকানা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় বণিক শ্রেণি শক্তিশালী হয় এবং তাদের সম্পত্তির অধিকার রক্ষার জন্য আইনি কাঠামো গড়ে উঠতে শুরু করে। এই সময়ে সম্পদের Accumulation বা সঞ্চয় একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক নীতি হিসেবে বিবেচিত হয়।
৫. শিল্প বিপ্লবের প্রভাব (অষ্টাদশ-ঊনবিংশ শতাব্দী): শিল্প বিপ্লব সম্পত্তির ধারণায় এক বড় ধরনের পরিবর্তন আনে। কলকারখানা, যন্ত্রপাতি এবং উৎপাদিত পণ্য ব্যক্তিগত মালিকানায় আসে। নতুন শিল্পপতি শ্রেণির উত্থান হয়, যারা প্রথাগত ভূমিভিত্তিক অভিজাতদের পাশাপাশি অর্থনৈতিক ক্ষমতার অধিকারী হন। শ্রমিক শ্রেণি তাদের শ্রম বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করত, কিন্তু উৎপাদনের উপায়ের মালিকানা তাদের হাতে ছিল না।
৬. ধনতন্ত্রের বিকাশ (উনবিংশ-বিংশ শতাব্দী): ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকার আরও সুপ্রতিষ্ঠিত হয়। মুক্তবাজার অর্থনীতি এবং প্রতিযোগিতার ধারণার বিস্তার ঘটে। সম্পত্তির মালিকানা লাভের সুযোগ বৃদ্ধি পায়, তবে একই সাথে সম্পদ বণ্টনের ক্ষেত্রে বৈষম্যও দেখা যায়। বিভিন্ন আইনি কাঠামো এবং প্রতিষ্ঠান সম্পত্তির অধিকার রক্ষা এবং বাণিজ্যিক লেনদেনকে সহজ করে তোলে।
৭. সমাজতান্ত্রিক চিন্তাধারার প্রভাব (বিংশ শতাব্দী): ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থার সমালোচনা এবং শ্রমিক শ্রেণির অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সমাজতান্ত্রিক চিন্তাধারার উদ্ভব হয়। সম্পত্তির ব্যক্তিগত মালিকানার পরিবর্তে রাষ্ট্রীয় বা সামাজিক মালিকানার ধারণা গুরুত্ব পায়। বিংশ শতাব্দীতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব এবং রাষ্ট্রীয় মালিকানার নীতি বাস্তবায়িত হতে দেখা যায়।
৮. কল্যাণ রাষ্ট্রের ধারণা (বিংশ শতাব্দী): দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর অনেক দেশেই কল্যাণ রাষ্ট্রের ধারণা গড়ে ওঠে। এর মূল লক্ষ্য ছিল বাজারের ব্যর্থতা মোকাবেলা করা এবং নাগরিকদের সামাজিক সুরক্ষা প্রদান করা। সম্পত্তির ব্যক্তিগত মালিকানা বজায় রেখেও রাষ্ট্র শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা এবং সামাজিক নিরাপত্তার মাধ্যমে নাগরিকদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে ভূমিকা রাখে।
৯. বৈশ্বিক অর্থনীতির প্রভাব (বিংশ-একবিংশ শতাব্দী): globalization বা বিশ্বায়ন সম্পত্তির ধারণাকে আরও জটিল করে তোলে। আন্তর্জাতিক বাণিজ্য, বিনিয়োগ এবং প্রযুক্তিগত উন্নয়নের ফলে বিভিন্ন দেশে সম্পত্তির মালিকানা এবং লেনদেনের ধরণে পরিবর্তন আসে। বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর সম্পত্তির ব্যবস্থাপনা এবং আন্তর্জাতিক আইনি কাঠামোর গুরুত্ব বৃদ্ধি পায়।
১০. প্রযুক্তি ও মেধাভিত্তিক সম্পত্তির গুরুত্ব বৃদ্ধি (একবিংশ শতাব্দী): বর্তমানে জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতির যুগে মেধাভিত্তিক সম্পত্তি যেমন – পেটেন্ট, ট্রেডমার্ক, কপিরাইট ইত্যাদির গুরুত্ব ক্রমশ বাড়ছে। উদ্ভাবন এবং সৃজনশীলতাকে উৎসাহিত করার জন্য এই ধরনের সম্পত্তির আইনি সুরক্ষা অপরিহার্য। তথ্যপ্রযুক্তি এবং ইন্টারনেট নতুন ধরনের সম্পত্তির সৃষ্টি করেছে, যেমন – ডোমেইন নাম, ডিজিটাল কনটেন্ট ইত্যাদি।
১১. পরিবেশগত সম্পত্তির ধারণা (একবিংশ শতাব্দী): পরিবেশগত ভারসাম্য রক্ষার জন্য বনভূমি, জলাধার এবং প্রাকৃতিক সম্পদের উপর অধিকার এবং ব্যবস্থাপনার ধারণা পরিবর্তিত হচ্ছে। টেকসই উন্নয়ন এবং পরিবেশ সুরক্ষার লক্ষ্যে রাষ্ট্র এবং আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো বিভিন্ন নীতি প্রণয়ন করছে। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য প্রাকৃতিক সম্পদ রক্ষা করা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
১২. নাগরিক সমাজের ভূমিকা: সম্পত্তির অধিকার এবং ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে নাগরিক সমাজ এবং বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তারা প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সম্পত্তির অধিকার রক্ষা, পরিবেশ সচেতনতা বৃদ্ধি এবং নীতি নির্ধারণে প্রভাব ফেলে।
১৪. জরিপের প্রভাব: বিভিন্ন সময়ে পরিচালিত জরিপ সম্পত্তির মালিকানা এবং বণ্টনের চিত্র তুলে ধরে। যেমন – বিশ্বব্যাপী সম্পদ বৈষম্য নিয়ে বিভিন্ন গবেষণা দারিদ্র্য বিমোচন এবং সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে নীতি নির্ধারণে সহায়ক ভূমিকা পালন করে।
১৫. ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট: বিভিন্ন দেশের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট সম্পত্তির বিবর্তনের ধারাকে ভিন্ন রূপ দিয়েছে। ঔপনিবেশিক শাসন, ভূমি সংস্কার আন্দোলন এবং রাজনৈতিক পালাবদল সম্পত্তির মালিকানা কাঠামোকে প্রভাবিত করেছে।
১৬. সামাজিক ন্যায়বিচার: সম্পত্তির অধিকার এবং বণ্টনের ক্ষেত্রে সামাজিক ন্যায়বিচারের প্রশ্নটি গুরুত্বপূর্ণ। সমাজের সকল স্তরের মানুষের জন্য সম্পদের সমান সুযোগ এবং ন্যায্য বন্টন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বিভিন্ন নীতি প্রণয়ন করা হয়।
১৭. রাজনৈতিক প্রভাব: রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং সরকারের নীতি সম্পত্তির অধিকার এবং বিনিয়োগের পরিবেশকে প্রভাবিত করে। একটি স্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিবেশ অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য অপরিহার্য।
১৮. সাংস্কৃতিক প্রভাব: সম্পত্তির প্রতি মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি এবং মূল্যবোধ বিভিন্ন সংস্কৃতিতে ভিন্ন ভিন্ন হতে পারে। উত্তরাধিকার প্রথা, দান এবং সামাজিক প্রথা সম্পত্তির হস্তান্তর এবং মালিকানার উপর প্রভাব ফেলে।
১৯. প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও সম্পত্তির অধিকার: বন্যা, খরা বা ভূমিকম্পের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ মানুষের সম্পত্তির উপর বড় ধরনের প্রভাব ফেলতে পারে। দুর্যোগ পরবর্তী পুনর্বাসন এবং সম্পত্তির অধিকার পুনরুদ্ধার একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
২০. নগরায়ন ও সম্পত্তির চাহিদা: নগরায়ণের ফলে জমির চাহিদা বৃদ্ধি পায় এবং সম্পত্তির মূল্য বেড়ে যায়। শহরে আবাসন সংকট এবং ভূমি ব্যবস্থাপনার চ্যালেঞ্জ দেখা দেয়।
২১. ভবিষ্যতের সম্পত্তির ধারণা: প্রযুক্তি এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে ভবিষ্যতের সম্পত্তির ধারণা আরও পরিবর্তিত হতে পারে। ভার্চুয়াল রিয়ালিটি, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এবং নবায়নযোগ্য ऊर्जा সম্পদের নতুন রূপ দিতে পারে।
উপসংহার:- সম্পত্তির বিবর্তন একটি চলমান প্রক্রিয়া। আদিম সমাজের গোষ্ঠীভিত্তিক অধিকার থেকে শুরু করে আধুনিক যুগের জটিল আইনি কাঠামো এবং প্রযুক্তিগত প্রভাব – সম্পত্তির ধারণা সময়ের সাথে সাথে পরিবর্তিত হয়েছে। এই বিবর্তন কেবল অর্থনৈতিক নয়, সামাজিক, রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটেরও প্রতিফলন। ভবিষ্যতের পৃথিবীতে জনসংখ্যা বৃদ্ধি, জলবায়ু পরিবর্তন এবং প্রযুক্তিগত অগ্রগতির সাথে সাথে সম্পত্তির ধারণা আরও নতুন রূপ নেবে, যেখানে টেকসই উন্নয়ন এবং সামাজিক ন্যায়বিচার একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হবে।
আদিম সমাজে সম্পত্তির ধারণা, কৃষিভিত্তিক সমাজে পরিবর্তন, সামন্তবাদের উত্থান, বণিকবাদের প্রভাব, শিল্প বিপ্লবের প্রভাব, ধনতন্ত্রের বিকাশ, সমাজতান্ত্রিক চিন্তাধারার প্রভাব, কল্যাণ রাষ্ট্রের ধারণা, বৈশ্বিক অর্থনীতির প্রভাব, প্রযুক্তি ও মেধাভিত্তিক সম্পত্তির গুরুত্ব বৃদ্ধি, পরিবেশগত সম্পত্তির ধারণা, নাগরিক সমাজের ভূমিকা, আইনের বিবর্তন, জরিপের প্রভাব, ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট, সামাজিক ন্যায়বিচার, রাজনৈতিক প্রভাব, সাংস্কৃতিক প্রভাব, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও সম্পত্তির অধিকার, নগরায়ণ ও সম্পত্তির চাহিদা, ভবিষ্যতের সম্পত্তির ধারণা।
- ১৮৫৬: ব্রিটেনে নারী সম্পত্তি আইন পাস।
- ১৯১৭: রুশ বিপ্লবে সম্পত্তি রাষ্ট্রীয়করণ।
- ১৯৭২: স্টকহোম কনফারেন্সে প্রাকৃতিক সম্পদ নীতি নির্ধারণ।
- ২০২০: বিশ্বের ১% মানুষ ৪৪% সম্পদের মালিক (ক্রেডিট সুইস রিপোর্ট)।
- ২০২১: NFT বাজার ৪১ বিলিয়ন ডলার ছাড়ায়।