- readaim.com
- 0

উত্তর::ভূমিকা:- মানব সমাজ সর্বদা বিভিন্ন স্তরে বিভক্ত। এই স্তরবিন্যাস সমাজের সদস্যদের সুযোগ-সুবিধা, ক্ষমতা এবং সামাজিক মর্যাদার ক্ষেত্রে ভিন্নতা সৃষ্টি করে। ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট থেকে শুরু করে আধুনিক সমাজ পর্যন্ত, সামাজিক স্তরবিন্যাসের বিভিন্ন ধরণ বিদ্যমান। এই নিবন্ধে সামাজিক স্তরবিন্যাসের প্রধান ধরণগুলো সহজ ভাষায় আলোচনা করা হবে, যা সমাজের অন্তর্নিহিত কাঠামো বুঝতে সাহায্য করবে।
সামাজিক স্তরবিন্যাসের প্রধান ধরণসমূহ:-
১.দাসপ্রথা: সামাজিক স্তরবিন্যাসের প্রাচীনতম রূপগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো দাসপ্রথা। এখানে কিছু মানুষ জন্মগতভাবে বা বলপ্রয়োগের মাধ্যমে অন্যের ব্যক্তিগত সম্পত্তিতে পরিণত হয়। তাদের কোনো স্বাধীনতা বা অধিকার থাকে না। প্রাচীন গ্রীস ও রোমান সাম্রাজ্যে এর ব্যাপক প্রচলন ছিল। উদাহরণস্বরূপ, খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দীতে এথেন্সে মোট জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশ ছিল দাস। উনিশ শতকে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণাঞ্চলে দাসপ্রথা বিলুপ্ত হয়।
২.বর্ণপ্রথা: এই ধরণের স্তরবিন্যাস মূলত ভারতীয় উপমহাদেশে দেখা যায়। এখানে জন্মগতভাবে মানুষের সামাজিক অবস্থান নির্ধারিত হয় এবং এটি বংশানুক্রমিকভাবে চলে। ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র – এই চারটি প্রধান বর্ণ এবং এর বাইরে অস্পৃশ্য বা দলিত শ্রেণী বিদ্যমান। যদিও ভারতীয় সংবিধানে বর্ণপ্রথার বিলুপ্তি ঘটানো হয়েছে, তবুও গ্রামীণ সমাজে এর প্রভাব এখনো লক্ষণীয়। এমনকি ২০১১ সালের আদমশুমারি অনুসারে, দলিতরা এখনো সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে বৈষম্যের শিকার।
৩.এস্টেট প্রথা: মধ্যযুগে ইউরোপে এই প্রথা প্রচলিত ছিল। এটি মূলত ভূমিভিত্তিক স্তরবিন্যাস, যেখানে সমাজ তিনটি প্রধান শ্রেণীতে বিভক্ত ছিল: অভিজাত শ্রেণী (যাদের হাতে জমি ও ক্ষমতা ছিল), যাজক শ্রেণী (ধর্মীয় কর্তৃত্ব যাদের ছিল) এবং সাধারণ প্রজা (যারা ভূমি চাষ করত)। ফরাসি বিপ্লবের (১৭৮৯) পূর্বে ফ্রান্সে এই ধরণের সমাজ ব্যবস্থা বিদ্যমান ছিল। এই ব্যবস্থায় সামাজিক গতিশীলতা প্রায় অনুপস্থিত ছিল।
৪.শ্রেণী প্রথা: আধুনিক শিল্পভিত্তিক সমাজে শ্রেণী প্রথা একটি গুরুত্বপূর্ণ স্তরবিন্যাস। এখানে মানুষের সামাজিক অবস্থান মূলত অর্থনৈতিক সম্পদের (যেমন – অর্থ, সম্পত্তি, পেশা) উপর ভিত্তি করে নির্ধারিত হয়। কার্ল মার্কস বুর্জোয়া (ধনী মালিক শ্রেণী) ও প্রলেতারিয়েত (শ্রমিক শ্রেণী)- এই দুটি প্রধান শ্রেণীর কথা উল্লেখ করেছেন। তবে ম্যাক্স ওয়েবার সামাজিক শ্রেণীকে শুধুমাত্র অর্থনীতির ভিত্তিতে নয়, বরং মর্যাদা ও রাজনৈতিক ক্ষমতার ভিত্তিতেও বিশ্লেষণ করেছেন। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, উন্নত দেশগুলোতেও আয়ের বৈষম্য এখনো বিদ্যমান। যেমন, অক্সফ্যামের ২০১৭ সালের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বের আটজন ধনী ব্যক্তির কাছে বিশ্বের দরিদ্রতম অর্ধেক জনগোষ্ঠীর সমান সম্পদ রয়েছে।
৫.লিঙ্গভিত্তিক স্তরবিন্যাস: সমাজ লিঙ্গের ভিত্তিতেও স্তরবিন্যস্ত হতে পারে। পুরুষ ও নারীর সামাজিক ভূমিকা, সুযোগ ও ক্ষমতার ক্ষেত্রে পার্থক্য দেখা যায়। পিতৃতান্ত্রিক সমাজে পুরুষরা সাধারণত নারীদের তুলনায় বেশি ক্ষমতা ও সুযোগ ভোগ করে। বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের ‘গ্লোবাল জেন্ডার gap রিপোর্ট ২০২৩’ অনুসারে, এখনো বিশ্বের কোনো দেশেই সম্পূর্ণরূপে লিঙ্গ সমতা অর্জিত হয়নি। কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ বাড়লেও, বেতনের ক্ষেত্রে বৈষম্য এখনো বিদ্যমান।
৬.জাতিগত ও গোষ্ঠীগত স্তরবিন্যাস: জাতি, গোষ্ঠী বা নৃতাত্ত্বিক পরিচয়ের ভিত্তিতেও সমাজে স্তরবিন্যাস দেখা যায়। কোনো বিশেষ জাতি বা গোষ্ঠীর মানুষ সংখ্যালঘু বা প্রান্তিক হওয়ার কারণে বৈষম্যের শিকার হতে পারে। দক্ষিণ আফ্রিকায় দীর্ঘকাল ধরে চলা বর্ণবাদ (অ্যাপার্টহাইড) এর একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ। এমনকি আধুনিক সমাজেও বিভিন্ন দেশে জাতিগত সংখ্যালঘুরা সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে পিছিয়ে থাকতে দেখা যায়।
৭.বয়সভিত্তিক স্তরবিন্যাস: বয়সও সামাজিক স্তরবিন্যাসের একটি ভিত্তি হতে পারে। সমাজে শিশু, যুবক, বয়স্ক – এই তিনটি প্রধান বয়সস্তরে মানুষের ভূমিকা ও প্রত্যাশা ভিন্ন ভিন্ন। বয়স্ক ব্যক্তিরা অভিজ্ঞতা ও জ্ঞানের কারণে এক ধরণের মর্যাদা পেলেও, কর্মক্ষমতা কমে যাওয়ায় অনেক ক্ষেত্রে তারা অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে দুর্বল হতে পারেন।
৮.পেশাভিত্তিক স্তরবিন্যাস: বিভিন্ন পেশার সামাজিক মর্যাদা ও আয়ের ক্ষেত্রে ভিন্নতা দেখা যায়। সাধারণত উচ্চ বেতনের এবং সম্মানজনক পেশায় নিয়োজিত ব্যক্তিরা সমাজে উচ্চতর অবস্থানে থাকেন। যেমন – ডাক্তার, প্রকৌশলী, আইনজীবী প্রমুখের সামাজিক মর্যাদা তুলনামূলকভাবে বেশি। অন্যদিকে, কায়িক শ্রমনির্ভর পেশায় নিয়োজিত ব্যক্তিরা অনেক সময় কম মর্যাদা ও সুযোগ পান।
৯.শিক্ষাগত যোগ্যতার স্তরবিন্যাস: শিক্ষাগত যোগ্যতা সামাজিক স্তরবিন্যাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ নির্ধারক। উচ্চশিক্ষিত ব্যক্তিরা সাধারণত ভালো চাকরি ও বেশি আয় রোজগার করার সুযোগ পান এবং সমাজে তাদের মর্যাদা বেশি থাকে। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, শিক্ষার স্তর বৃদ্ধির সাথে সাথে মানুষের জীবনযাত্রার মানও উন্নত হয়।
১০.ক্ষমতা ও কর্তৃত্বভিত্তিক স্তরবিন্যাস: সমাজে ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের বণ্টনের ভিত্তিতেও স্তরবিন্যাস তৈরি হয়। রাজনৈতিক নেতা, সরকারি কর্মকর্তা বা প্রভাবশালী ব্যক্তিরা অন্যদের তুলনায় বেশি ক্ষমতা ও প্রভাব বিস্তার করেন। এই ক্ষমতা ব্যবহার করে তারা সমাজের সম্পদ ও সুযোগ-সুবিধা নিজেদের অনুকূলে রাখতে পারেন।
১১.গ্রামীণ ও শহুরে স্তরবিন্যাস: গ্রামীণ ও শহুরে জীবনযাত্রার সুযোগ ও সুবিধার ভিন্নতার কারণেও স্তরবিন্যাস দেখা যায়। শহরগুলোতে সাধারণত শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা ও কর্মসংস্থানের সুযোগ বেশি থাকে, যা গ্রামীণ অঞ্চলে তুলনামূলকভাবে কম। ফলে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর একটি অংশ পিছিয়ে থাকতে পারে।
১২.ধর্মভিত্তিক স্তরবিন্যাস: ধর্মীয় বিশ্বাস ও পরিচয়ের ভিত্তিতেও সমাজে স্তরবিন্যাস তৈরি হতে পারে। কোনো বিশেষ ধর্মাবলম্বী গোষ্ঠী সংখ্যাগরিষ্ঠ বা প্রভাবশালী হলে, অন্যান্য ধর্মাবলম্বীরা বৈষম্যের শিকার হতে পারে। বিভিন্ন দেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের প্রতি অসহিষ্ণুতা দেখা যায়।
১৩.শারীরিক ও মানসিক সক্ষমতাবিহীন ব্যক্তিদের স্তরবিন্যাস: শারীরিক বা মানসিক প্রতিবন্ধকতাযুক্ত ব্যক্তিরা সমাজে অনেক ক্ষেত্রে বৈষম্যের শিকার হন। তাদের জন্য শিক্ষা, কর্মসংস্থান ও সামাজিক অংশগ্রহণের সুযোগ সীমিত থাকতে পারে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা এই জনগোষ্ঠীর অধিকার আদায়ে কাজ করছে।
১৪.আঞ্চলিক স্তরবিন্যাস: ভৌগোলিক অঞ্চলের ভিন্নতার কারণেও সামাজিক স্তরবিন্যাস দেখা যায়। কোনো উন্নত অঞ্চলের তুলনায় একটি অনুন্নত অঞ্চলের মানুষ শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হতে পারে।
১৫.প্রযুক্তিনির্ভর স্তরবিন্যাস: আধুনিক যুগে প্রযুক্তির ব্যবহারেও একটি নতুন ধরণের স্তরবিন্যাস তৈরি হচ্ছে। যারা প্রযুক্তি ব্যবহারে দক্ষ এবং যাদের কাছে আধুনিক প্রযুক্তির সুবিধা রয়েছে, তারা তুলনামূলকভাবে এগিয়ে থাকছে। ডিজিটাল ডিভাইড বা ডিজিটাল বৈষম্য এক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
১৬.সাংস্কৃতিক স্তরবিন্যাস: সংস্কৃতি ও জীবনযাত্রার ধরনের ভিন্নতার কারণেও স্তরবিন্যাস দেখা যায়। কোনো প্রভাবশালী সংস্কৃতির অনুসারীরা অন্যদের তুলনায় বেশি সুবিধা ও মর্যাদা পেতে পারে।
১৭.অপরাধ ও বিচ্যুতির ভিত্তিতে স্তরবিন্যাস: যারা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত বা সামাজিক norms ভঙ্গ করে, তারা সমাজে নিম্নস্তরে পতিত হয় এবং সামাজিক stigmatism-এর শিকার হয়।
১৮.বৈবাহিক অবস্থার ভিত্তিতে স্তরবিন্যাস: বিবাহিত ও অবিবাহিত অথবা বিভিন্ন ধরণের পারিবারিক কাঠামোর ভিত্তিতেও সামাজিক স্তরবিন্যাস দেখা যেতে পারে। কিছু সমাজে বিবাহিত ব্যক্তিদের অবিবাহিতদের তুলনায় বেশি সামাজিক মর্যাদা দেওয়া হয়।
১৯.পোশাক ও জীবনযাত্রার মানের ভিত্তিতে স্তরবিন্যাস: মানুষের পোশাক-পরিচ্ছদ ও জীবনযাত্রার মানও সামাজিক স্তরবিন্যাসের একটি বাহ্যিক পরিচায়ক হতে পারে। উচ্চ জীবনযাত্রার অধিকারী ব্যক্তিরা সাধারণত সমাজে বেশি মর্যাদা পান।
২০.ভাষাগত স্তরবিন্যাস: ভাষার ভিন্নতার কারণেও সামাজিক স্তরবিন্যাস তৈরি হতে পারে। কোনো একটি নির্দিষ্ট ভাষার ব্যবহারকারী গোষ্ঠী প্রভাবশালী হলে, অন্য ভাষার ব্যবহারকারীরা সুযোগের ক্ষেত্রে পিছিয়ে থাকতে পারে।
উপসংহার:- সামাজিক স্তরবিন্যাস একটি জটিল ও বহুমাত্রিক ধারণা। বিভিন্ন ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট ও আর্থ-সামাজিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে এর বিভিন্ন ধরণ বিকশিত হয়েছে। দাসপ্রথা থেকে শুরু করে আধুনিক সমাজের শ্রেণী, লিঙ্গ, জাতি বা প্রযুক্তিনির্ভর স্তরবিন্যাস – প্রতিটি ধরণই সমাজের সদস্যদের সুযোগ, ক্ষমতা ও মর্যাদার ক্ষেত্রে ভিন্নতা তৈরি করে। এই স্তরবিন্যাসগুলো সমাজের স্থিতিশীলতা ও পরিবর্তনের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
দাসপ্রথা, বর্ণপ্রথা, এস্টেট প্রথা, শ্রেণী প্রথা, লিঙ্গভিত্তিক স্তরবিন্যাস, জাতিগত ও গোষ্ঠীগত স্তরবিন্যাস, বয়স ভিত্তিক স্তরবিন্যাস, পেশাভিত্তিক স্তরবিন্যাস, শিক্ষাগত যোগ্যতার স্তরবিন্যাস, ক্ষমতা ও কর্তৃত্বভিত্তিক স্তরবিন্যাস, গ্রামীণ ও শহুরে স্তরবিন্যাস, ধর্মভিত্তিক স্তরবিন্যাস, শারীরিক ও মানসিক সক্ষমতাবিহীন ব্যক্তিদের স্তরবিন্যাস, আঞ্চলিক স্তরবিন্যাস, প্রযুক্তিনির্ভর স্তরবিন্যাস, সাংস্কৃতিক স্তরবিন্যাস, অপরাধ ও বিচ্যুতির ভিত্তিতে স্তরবিন্যাস, বৈবাহিক অবস্থার ভিত্তিতে স্তরবিন্যাস, পোশাক ও জীবনযাত্রার মানের ভিত্তিতে স্তরবিন্যাস, ভাষাগত স্তরবিন্যাস, বিনোদন ও অবকাশ যাপনের সুযোগের ভিত্তিতে স্তরবিন্যাস।
সামাজিক স্তরবিন্যাসের ইতিহাসে উল্লেখযোগ্য ঘটনা হলো ১৭৮৯ সালের ফরাসি বিপ্লব, যা সামন্ততন্ত্রের পতন ঘটায়। ১৯৪৮ সালে জাতিসংঘের মানবাধিকার ঘোষণাপত্র সাম্যতার কথা বলে। ২০২০ সালে Black Lives Matter আন্দোলন বর্ণবৈষম্য নিয়ে সচেতনতা বাড়ায়। বাংলাদেশে ১৯৭২ সালের সংবিধানে সমতা নিশ্চিত করা হলেও বাস্তবে বৈষম্য রয়ে গেছে। বিশ্বব্যাংকের ২০২৩ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বৈশ্বিক অসমতা COVID-19 পরিস্থিতিতে আরও বেড়েছে।