- readaim.com
- 0

উত্তর::ভূমিকা:- ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান বাংলাদেশের ইতিহাসে এক যুগান্তকারী ঘটনা। এটি ছিল পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর শোষণ ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত বিদ্রোহ। শিক্ষার্থী, শ্রমিক, কৃষক ও সর্বস্তরের মানুষ এই আন্দোলনে যোগ দিয়ে স্বৈরাচার বিরোধী চেতনাকে শক্তিশালী করেছিল। এই অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়েই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে স্বাধীনতা সংগ্রামের পথ সুগম হয়।
১।পাকিস্তানের অর্থনৈতিক শোষণ:- ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের মূল কারণ ছিল পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের অর্থনৈতিক শোষণ। পূর্ব পাকিস্তানের (বর্তমান বাংলাদেশ) সম্পদ পশ্চিম পাকিস্তানের উন্নয়নে ব্যবহৃত হচ্ছিল। ১৯৫০-৬০-এর দশকে পূর্ব পাকিস্তানের মাথাপিছু আয় ছিল মাত্র ৩০০ ডলার, যা পশ্চিম পাকিস্তানের তুলনায় অর্ধেকেরও কম। এছাড়া, বৈদেশিক বাণিজ্যের মাত্র ২৫% লাভ পূর্ব পাকিস্তান পেত, অথচ জনসংখ্যা ছিল ৫৬%।
২।রাজনৈতিক বৈষম্য ও স্বায়ত্তশাসনের দাবি:- পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী পূর্ব পাকিস্তানের জনগণকে রাজনৈতিকভাবে উপেক্ষা করত। ১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৬ দফা দাবি পেশ করেন, যা ছিল স্বায়ত্তশাসনের রূপরেখা। কিন্তু পাকিস্তান সরকার এই দাবি প্রত্যাখ্যান করে এবং শেখ মুজিবসহ অন্যান্য নেতাকে গ্রেফতার করে। এতে জনগণের ক্ষোভ বৃদ্ধি পায় এবং ১৯৬৯ সালে তা গণঅভ্যুত্থানে রূপ নেয়।
৩।ছাত্র আন্দোলনের ভূমিকা:- ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানে ছাত্ররা অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। তারা ১১ দফা দাবি পেশ করে, যার মধ্যে ছিল সামরিক শাসন প্রত্যাহার, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ও অর্থনৈতিক ন্যায়বিচার। ২০, জানুয়ারি ১৯৬৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা পুলিশের গুলিতে শহীদ হন, যা সমগ্র দেশে বিদ্রোহের আগুন জ্বালিয়ে দেয়। এই আন্দোলন দ্রুত সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে এবং লক্ষাধিক মানুষ রাস্তায় নেমে আসে।
৪।আইয়ুব খানের পতন:- গণঅভ্যুত্থানের চাপে পাকিস্তানের স্বৈরশাসক জেনারেল আইয়ুব খান ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হন। ১৯৬৯ সালের ২৫ মার্চ তিনি পদত্যাগ করেন এবং জেনারেল ইয়াহিয়া খান নতুন শাসক হিসেবে ক্ষমতা গ্রহণ করেন। এই ঘটনা প্রমাণ করে যে জনগণের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন যে কোনো স্বৈরশাসককে পরাজিত করতে পারে। আইয়ুব খানের পতনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন নতুন গতি পায়।
৫।স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রস্তুতি:- ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ভিত্তি তৈরি করে দেয়। এই আন্দোলনের মাধ্যমে বাঙালি জাতি বুঝতে পারে যে শান্তিপূর্ণ উপায়ে তাদের অধিকার আদায় সম্ভব নয়। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিজয় এবং পরবর্তীতে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের পথ সুগম হয় এই গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়েই।
৬।শ্রমিক ও কৃষকদের ব্যাপক অংশগ্রহণ:- ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানে শুধু ছাত্ররাই নয়, শ্রমিক ও কৃষকরাও সক্রিয়ভাবে অংশ নেয়। পাকিস্তানি শাসনের বিরুদ্ধে গার্মেন্টস শ্রমিক, রেলওয়ে কর্মচারী ও কৃষকেরা ধর্মঘট ও মিছিলে যোগ দেন। ১৯৬৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে নারায়ণগঞ্জের আদমজী জুট মিলের শ্রমিকরা বিক্ষোভ করে, যা পুরো শিল্পাঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। কৃষকরা জমিদারি প্রথা ও খাজনার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়, যা গণআন্দোলনকে ব্যাপকতা দেয়।
৭।সংস্কৃতি ও গণমাধ্যমের ভূমিকা:- এই আন্দোলনে সংস্কৃতি ও গণমাধ্যম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কবি, শিল্পী ও সাহিত্যিকরা গণজাগরণ সৃষ্টিতে কাজ করেন। শহীদ মিনারে সঙ্গীতানুষ্ঠান, কবিতা পাঠ ও নাটক মঞ্চস্থ হতো, যা মানুষকে উদ্বুদ্ধ করত। পত্রিকাগুলো (যেমন—ইত্তেফাক, সংবাদ) সরকারের সেন্সরশিপ উপেক্ষা করে সত্য ঘটনা প্রকাশ করত। রেডিও পাকিস্তানের বিকল্প হিসেবে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের ধারণাও এই সময়েই জন্ম নেয়।
৮।নারীসমাজের অংশগ্রহণ:- নারীসমাজ এই আন্দোলনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী, শিক্ষিকা ও গৃহিণীরা মিছিলে অংশ নিয়ে পাকিস্তানি বাহিনীর দমনপীড়নের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান। বেগম সুফিয়া কামাল, মালেকা বেগমের মতো নেত্রীরা নারীদের সংগঠিত করেন। নারীরা শ্লোগান দিতেন—”জাগো জাগো নারী জাগো, অন্যায়ের বিরুদ্ধে জাগো!” এই অংশগ্রহণ ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে নারীদের সাহসিকতার পথ তৈরি করে।
৯।সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে গণপ্রতিরোধ:- ১৯৫৮ সাল থেকে জারি হওয়া মার্শাল ল’ (সামরিক শাসন) এর বিরুদ্ধে ১৯৬৯ সালের আন্দোলন ছিল স্পষ্ট চ্যালেঞ্জ। আইয়ুব খানের “মৌলিক গণতন্ত্র” নামের ভুয়া ব্যবস্থাকে মানুষ প্রত্যাখ্যান করে। আন্দোলনের চাপে ১৯৬৯ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি সামরিক ট্রাইব্যুনালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ অন্যান্য নেতার মুক্তি দিতে বাধ্য হয় পাকিস্তান সরকার। এটি প্রমাণ করে গণআন্দোলন কতটা শক্তিশালী ছিল।
১০।আন্তর্জাতিক প্রভাব ও সমর্থন:- এই গণঅভ্যুত্থান আন্তর্জাতিক মহলে আলোড়ন সৃষ্টি করে। ভারত, ব্রিটেন ও মার্কিন সংবাদমাধ্যমে পাকিস্তানি শাসনের নৃশংসতা নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। কলকাতার পত্রিকাগুলো পূর্ব পাকিস্তানের সংগ্রামকে সমর্থন জানায়। আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংগঠনগুলো (ILO) পাকিস্তানের শ্রমিক নিপীড়নের নিন্দা করে। এই সমর্থন পরোক্ষভাবে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বিশ্বজনমত গঠনে সহায়তা করে।
উপসংহার:- ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান বাংলাদেশের ইতিহাসে এক অনন্য অধ্যায়। এটি শুধু একটি রাজনৈতিক আন্দোলন নয়, বাঙালির স্বাধিকার ও স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষার প্রকাশ। এই আন্দোলনের মাধ্যমেই বাঙালি জাতি বুঝতে পেরেছিল যে তাদের সংঘবদ্ধ শক্তির কাছে কোনো শাসকই টিকতে পারে না। পরবর্তীতে এই চেতনাই ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রেরণা যুগিয়েছিল।
📌 পাকিস্তানের অর্থনৈতিক শোষণ
📌 রাজনৈতিক বৈষম্য ও ৬ দফা দাবি
📌 ছাত্রদের ১১ দফা ও আন্দোলনের নেতৃত্ব
📌 আইয়ুব খানের পতন
📌 স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রস্তুতি
🕊️ শ্রমিক ও কৃষকদের ব্যাপক অংশগ্রহণ
🕊️ সংস্কৃতি ও গণমাধ্যমের ভূমিকা
🕊️ নারীসমাজের অংশগ্রহণ
🕊️ সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে গণপ্রতিরোধ
🕊️ আন্তর্জাতিক প্রভাব ও সমর্থন
১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আসাদুজ্জামান আসাদ পুলিশের গুলিতে নিহত হন (২০ জানুয়ারি, ১৯৬৯)। পরবর্তীতে ডাকসুর ভিপি তোফায়েল আহমেদের নেতৃত্বে ছাত্ররা ১১ দফা দাবি পেশ করে। এই আন্দোলনে প্রায় ১০ লক্ষ মানুষ অংশগ্রহণ করে। ১৯৬৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে সারাদেশে কারফিউ জারি করা হয়, কিন্তু জনগণ তা উপেক্ষা করে। এই আন্দোলনের ফলেই ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়।