- readaim.com
- 0

উত্তর::ভূমিকা:- ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ভাষণটি ছিল বাঙালির স্বাধীনতা সংগ্রামের এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ। এটি কেবল একটি ভাষণ ছিল না, ছিল পরাধীন জাতির মুক্তির সনদ, শৃঙ্খল ভাঙার মন্ত্র। এই ভাষণেই বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ডাক দিয়েছিলেন, যা আপামর জনতাকে ঐক্যবদ্ধ করেছিল পাকিস্তানি দুঃশাসনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে। 7ই মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণ একদিকে যেমন বাঙালিকে স্বাধীনতার মন্ত্রে দীক্ষিত করেছিল, অন্যদিকে তেমনি বিশ্ববাসীকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের যৌক্তিকতা উপলব্ধি করিয়েছিল।
১.স্বাধীনতার সুস্পষ্ট ঘোষণা: ৭ই মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধু কৌশলে এবং অত্যন্ত দূরদর্শীতার সাথে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন। তিনি সরাসরি স্বাধীনতা ঘোষণা না করে “এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম” বলে স্বাধীনতার পথ খুলে দিয়েছিলেন। এই উক্তিটি একদিকে যেমন সাধারণ মানুষকে যুদ্ধের জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত করেছিল, অন্যদিকে তেমনি পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীকে সরাসরি আক্রমণ করার সুযোগ দেয়নি। এই ভাষণের পর থেকেই বাঙালি জনতা স্বাধীনতার স্বপ্ন বুকে ধারণ করে মুক্তি সংগ্রামের জন্য নিজেদের প্রস্তুত করতে শুরু করে। এটি ছিল জাতির চূড়ান্ত লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যাওয়ার প্রথম ধাপ, যা পরবর্তীতে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত হয়।
২.দিকনির্দেশনামূলক ভাষণ: ৭ই মার্চের ভাষণ ছিল একটি সুনির্দিষ্ট দিকনির্দেশনামূলক ভাষণ। বঙ্গবন্ধু এই ভাষণে অসহযোগ আন্দোলনের বিস্তারিত রূপরেখা তুলে ধরেছিলেন। তিনি সরকারি অফিস, আদালত, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখার নির্দেশ দেন এবং খাজনা, কর না দেওয়ার আহ্বান জানান। একই সাথে তিনি প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য প্রতিটি ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলার কথা বলেন। এই নির্দেশনাগুলো তৎকালীন পরিস্থিতিতে বাঙালি জাতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল, কারণ এটি তাদের প্রতিরোধের জন্য একটি কাঠামো তৈরি করে দিয়েছিল। এই নির্দেশনার ফলস্বরূপ সারাদেশে পাকিস্তানি শাসনের বিরুদ্ধে এক অভূতপূর্ব প্রতিরোধ গড়ে ওঠে।
৩.বাঙালি জাতির ঐক্যবদ্ধতা: বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ বাঙালি জাতিকে এক অভূতপূর্ব ঐক্যে আবদ্ধ করেছিল। এই ভাষণের পর ধর্ম, বর্ণ, গোত্র নির্বিশেষে সকল বাঙালি এক পতাকাতলে সমবেত হয়। ভাষণের প্রতিটি শব্দ সাধারণ মানুষের হৃদয়ে গভীর প্রভাব ফেলেছিল এবং তাদের মধ্যে দেশপ্রেম ও স্বাধীনতার স্পৃহা জাগিয়ে তোলে। এই ঐক্যই ছিল মুক্তিযুদ্ধের প্রধান শক্তি, যা পরবর্তীতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে পরাজিত করতে সাহায্য করে। এই ঐক্যের জোরেই বাঙালি জাতি ১৯৭১ সালের দীর্ঘ নয় মাস মরণপণ যুদ্ধ করে স্বাধীনতা অর্জন করে।
৪.আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায়: ৭ই মার্চের ভাষণের গভীরতা এবং এর অন্তর্নিহিত গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ বিশ্বব্যাপী প্রশংসিত হয়েছিল। এই ভাষণটি বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের স্বাধীনতার যৌক্তিকতা তুলে ধরতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ এই ভাষণের মাধ্যমে বাঙালির উপর পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর অন্যায়-অত্যাচার সম্পর্কে অবগত হয় এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতি সহানুভূতিশীল হয়ে ওঠে। এটি পরবর্তীতে আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায়ে সহায়ক হয়, যা মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত জরুরি ছিল।
৫.মুক্তিযুদ্ধের অনুপ্রেরণা: ৭ই মার্চের ভাষণ ছিল মুক্তিযুদ্ধের প্রধান অনুপ্রেরণা। এই ভাষণটি বাঙালি যোদ্ধাদের মনে সাহস ও উদ্দীপনা যুগিয়েছিল। রণাঙ্গনে যখন মুক্তিযোদ্ধারা যুদ্ধ করছিলেন, তখন এই ভাষণের প্রতিটি শব্দ তাদের শক্তি ও প্রেরণা যুগিয়েছিল। অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধা এই ভাষণ শুনে নিজেদের জীবন উৎসর্গ করতে উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন। এটি শুধু একটি ভাষণ ছিল না, ছিল একটি যুদ্ধের আহ্বান, একটি জাতির স্বাধীনতার প্রতিজ্ঞাপত্র। এই অনুপ্রেরণাই দীর্ঘ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা এনে দেয়।
৬.রাজনৈতিক দূরদর্শিতা: এই ভাষণে বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দূরদর্শিতার পরিচয় পাওয়া যায়। তিনি একদিকে যেমন স্বাধীনতার চূড়ান্ত আহ্বান জানান, অন্যদিকে তেমনি পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীকে আলোচনার পথ খোলা রেখে সুযোগ করে দেন। তিনি অত্যন্ত সতর্কতার সাথে এমন শব্দ ব্যবহার করেছিলেন যা একদিকে যেমন উস্কানিমূলক ছিল না, অন্যদিকে তেমনি বাঙালির আকাঙ্ক্ষাকে স্পষ্ট করেছিল। এই দূরদর্শীতার কারণে পাকিস্তানি সামরিক জান্তা সরাসরি আক্রমণ করার কোনো অজুহাত খুঁজে পায়নি এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের অবস্থান শক্তিশালী হয়েছিল।
৭.বাঙালির আত্মপরিচয়ের প্রতীক: ৭ই মার্চের ভাষণ বাঙালি জাতির আত্মপরিচয়ের প্রতীক। এই ভাষণের মধ্য দিয়েই বাঙালি জাতি নিজেদের একটি স্বাধীন জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখতে শুরু করে। এটি কেবল রাজনৈতিক মুক্তি নয়, সাংস্কৃতিক ও আত্মিক মুক্তিরও এক ইঙ্গিত ছিল। এই ভাষণ বাঙালিকে তাদের নিজস্ব সংস্কৃতি, ঐতিহ্য এবং ভাষার প্রতি গর্বিত হতে শিখিয়েছিল। এটি প্রজন্মের পর প্রজন্মকে তাদের ইতিহাস ও আত্মমর্যাদা সম্পর্কে সচেতন করে তোলে।
৮.স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের ভিত্তি: যদিও সরাসরি স্বাধীনতার ঘোষণা ছিল না, ৭ই মার্চের ভাষণই ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের ভিত্তি। পরবর্তীতে ২৬শে মার্চ বঙ্গবন্ধু কর্তৃক স্বাধীনতার আনুষ্ঠানিক ঘোষণার পূর্বে এই ভাষণই দেশের মানুষকে স্বাধীনতার জন্য প্রস্তুত করে তোলে। এই ভাষণ স্বাধীনতার আনুষ্ঠানিক ঘোষণার জন্য একটি প্রেক্ষাপট তৈরি করেছিল এবং জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে রেখেছিল। এই ভাষণের মাধ্যমেই স্বাধীনতার চেতনা জনগণের মনে প্রোথিত হয়েছিল।
৯.সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ভাষণ: ইউনেস্কো ২০১৭ সালের ৩০শে অক্টোবর ৭ই মার্চের ভাষণকে বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। এই স্বীকৃতি এই ভাষণের আন্তর্জাতিক গুরুত্ব এবং আবেদনকে প্রমাণ করে। এটি বিশ্বের অন্যতম সেরা ভাষণ হিসেবে বিবেচিত হয়েছে, যা একটি পরাধীন জাতিকে স্বাধীনতার জন্য একত্রিত করেছিল। এই ভাষণ শুধুমাত্র বাঙালির জন্য নয়, বিশ্বের সকল নিপীড়িত মানুষের জন্য অনুপ্রেরণার উৎস।
১০.ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য দৃষ্টান্ত: ৭ই মার্চের ভাষণ ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য এক অমূল্য দৃষ্টান্ত। এটি শেখায় কীভাবে একটি জাতিকে অন্যায়ের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ করতে হয় এবং স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করতে হয়। এই ভাষণ বাঙালি জাতির বীরত্ব, আত্মত্যাগ এবং স্বাধীনচেতার পরিচয় বহন করে। এটি আমাদের ইতিহাস, সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ, যা নতুন প্রজন্মকে তাদের পূর্বপুরুষদের সংগ্রাম সম্পর্কে অবগত করে।
উপসংহার:- ৭ই মার্চের বঙ্গবন্ধুর ভাষণ বাঙালির হৃদয়ে স্বাধীনতার বীজ বুনে দিয়েছিল। এটি ছিল বাঙালির মুক্তির স্বপ্নকে বাস্তবে রূপান্তর করার প্রথম ধাপ। এই ভাষণ শুধু একটি রাজনৈতিক বক্তব্য ছিল না, ছিল বাঙালি জাতির দীর্ঘদিনের শোষণ, বঞ্চনা ও পরাধীনতার বিরুদ্ধে দ্রোহের বহিঃপ্রকাশ। এই ভাষণ প্রতিটি বাঙালির মনে অদম্য সাহস ও আত্মবিশ্বাস যুগিয়েছিল, যার ফলশ্রুতিতে মাত্র নয় মাসের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত হয়েছিল স্বাধীন বাংলাদেশ। এই ভাষণ চিরকাল বাঙালি জাতির জন্য প্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে।
- স্বাধীনতার সুস্পষ্ট ঘোষণা
- দিকনির্দেশনামূলক ভাষণ
- বাঙালি জাতির ঐক্যবদ্ধতা
- আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায়
- মুক্তিযুদ্ধের অনুপ্রেরণা
- রাজনৈতিক দূরদর্শিতা
- বাঙালির আত্মপরিচয়ের প্রতীক
- স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের ভিত্তি
- সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ভাষণ
- ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য দৃষ্টান্ত
৭ই মার্চের ভাষণটি প্রায় ১৮ মিনিট স্থায়ী হয়েছিল। এই ভাষণের পূর্বে পাকিস্তান সরকার ঢাকায় কারফিউ জারি করেছিল এবং সামরিক বাহিনী প্রস্তুত ছিল। তবে বঙ্গবন্ধুর সুকৌশলী ভাষণ সরাসরি বিদ্রোহ ঘোষণা না করায় পাকিস্তান সরকার তাৎক্ষণিক কোনো কঠোর পদক্ষেপ নিতে পারেনি। ২০১৭ সালের ৩০শে অক্টোবর ইউনেস্কো এই ভাষণকে “মেমরি অফ দ্য ওয়ার্ল্ড ইন্টারন্যাশনাল রেজিস্টার” এ অন্তর্ভুক্ত করে। এটি ছিল বিশ্বের ৪২৭টি গুরুত্বপূর্ণ প্রামাণ্য ঐতিহ্যের মধ্যে একটি। এই ভাষণটি একটি নতুন জাতির জন্ম দিয়েছে এবং নিপীড়িত মানুষের জন্য স্বাধীনতার প্রতীক হয়ে আছে। ৭ই মার্চের ভাষণের পর থেকেই সারাদেশে অসহযোগ আন্দোলন তীব্র আকার ধারণ করে এবং বাঙালি জাতি মুক্তিযুদ্ধের জন্য চূড়ান্ত প্রস্তুতি নিতে শুরু করে।