- readaim.com
- 0
উত্তর::ভূমিকা: একটি দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা বোঝার জন্য কিছু মৌলিক ধারণা থাকা অপরিহার্য। মোট দেশজ উৎপাদন (GDP), মোট জাতীয় উৎপাদন (GNP), নিট জাতীয় উৎপাদন (NNP), জাতীয় আয় (NI), ব্যক্তিগত আয় (PI) এবং ব্যয়যোগ্য আয় (DI) হলো অর্থনীতির এই গুরুত্বপূর্ণ সূচকগুলো। এই সূচকগুলো একটি দেশের অর্থনৈতিক স্বাস্থ্য, প্রবৃদ্ধি এবং জনগণের জীবনযাত্রার মান পরিমাপ করতে সাহায্য করে। এই নিবন্ধে আমরা এই ধারণাগুলো সহজ ও আকর্ষণীয় ভাষায় ব্যাখ্যা করব।
১। GDP-একটি দেশের অর্থনৈতিক পরিধি: GDP বা Gross Domestic Product হলো একটি নির্দিষ্ট সময়ে (সাধারণত এক বছরে) একটি দেশের ভৌগোলিক সীমানার মধ্যে উৎপাদিত সব পণ্য ও সেবার মোট বাজার মূল্য। এর মধ্যে দেশি-বিদেশি উভয় প্রতিষ্ঠানের উৎপাদনই অন্তর্ভুক্ত থাকে, যদি তা দেশের অভ্যন্তরে ঘটে। এটি একটি দেশের অর্থনৈতিক কার্যকলাপের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পরিমাপক। উদাহরণস্বরূপ, বাংলাদেশে অবস্থিত কোনো বিদেশি কোম্পানির উৎপাদিত পণ্য ও সেবার মূল্য বাংলাদেশের GDP-এর অন্তর্ভুক্ত হবে। এটি একটি দেশের অর্থনৈতিক কার্যকলাপের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পরিমাপক।
২। GNP-দেশীয় নাগরিকদের উৎপাদন: GNP বা Gross National Product হলো একটি নির্দিষ্ট সময়ে একটি দেশের নাগরিকদের দ্বারা দেশ ও বিদেশে উৎপাদিত সব পণ্য ও সেবার মোট বাজার মূল্য। এটি GDP থেকে ভিন্ন, কারণ এখানে দেশের নাগরিকরা যেখানেই থাকুক না কেন, তাদের উৎপাদনকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। উদাহরণস্বরূপ, একজন বাংলাদেশি নাগরিক যদি আমেরিকায় কাজ করে অর্থ উপার্জন করেন, তবে সেই আয় বাংলাদেশের GNP-এর অন্তর্ভুক্ত হবে, কিন্তু GDP-এর নয়। এটি একটি দেশের নাগরিকদের সামগ্রিক অর্থনৈতিক অবদানের প্রতিচ্ছবি।
৩। NNP-মূলধন অবচয় বাদ দিয়ে: NNP বা Net National Product হলো GNP থেকে মূলধন অবচয় (Depreciation) বাদ দিয়ে প্রাপ্ত মোট আয়। মূলধন অবচয় হলো যন্ত্রপাতি, ভবন এবং অন্যান্য স্থায়ী সম্পদ ব্যবহারের ফলে যে ক্ষয় বা মূল্যহ্রাস হয়, তার আর্থিক মূল্য। NNP-এর মাধ্যমে একটি দেশের প্রকৃত উৎপাদন ক্ষমতা পরিমাপ করা হয়। অর্থাৎ, উৎপাদন প্রক্রিয়ায় ব্যবহৃত সম্পদের ক্ষয় বাদ দিয়ে একটি দেশের প্রকৃত অর্থনৈতিক অবস্থা কেমন, তা NNP থেকে বোঝা যায়। এটি একটি দেশের প্রকৃত অর্থনৈতিক স্বাস্থ্য বোঝার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ সূচক।
৪। NI-প্রকৃত জাতীয় আয়: NI বা National Income হলো NNP থেকে পরোক্ষ কর (Indirect Taxes) বাদ দিয়ে এবং ভর্তুকি (Subsidies) যোগ করে প্রাপ্ত মোট আয়। এটি একটি দেশের সমস্ত উৎপাদনশীল উপাদান, যেমন – শ্রম, ভূমি, পুঁজি এবং উদ্যোক্তাদের দ্বারা অর্জিত মোট আয়। NI-কে ফ্যাক্টর কস্ট-এর ভিত্তিতেও গণনা করা হয়, যা উৎপাদনের উপাদানগুলোর প্রকৃত মূল্য নির্দেশ করে। এটি একটি দেশের জনগণের মোট আয়কে প্রতিনিধিত্ব করে।
৫। PI-ব্যক্তিগত আয়: PI বা Personal Income হলো একটি দেশের জনগণের দ্বারা অর্জিত মোট আয়। এটি NI থেকে কর্পোরেশন ট্যাক্স, undistributed profits, এবং সামাজিক নিরাপত্তা অবদান বাদ দিয়ে, এবং ট্রান্সফার পেমেন্ট (যেমন- অবসর ভাতা, বেকার ভাতা) যোগ করে গণনা করা হয়। PI-এর মধ্যে সেই সব আয়ও অন্তর্ভুক্ত, যা মানুষ সরাসরি উৎপাদন প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ না করেও পেয়ে থাকে। PI মানুষের জীবনযাত্রার মান এবং ক্রয়ক্ষমতার একটি গুরুত্বপূর্ণ সূচক।
৬। DI-প্রকৃত ব্যবহারযোগ্য আয়: DI বা Disposable Income হলো ব্যক্তিগত আয় থেকে ব্যক্তিগত কর (যেমন- আয়কর) বাদ দিয়ে অবশিষ্ট অর্থ। এটি সেই পরিমাণ অর্থ, যা মানুষ তাদের ইচ্ছা মতো খরচ বা সঞ্চয় করতে পারে। DI-এর মাধ্যমে মানুষের প্রকৃত ক্রয়ক্ষমতা এবং ভোগের প্রবণতা বোঝা যায়। এই আয় সরাসরি মানুষের ভোগ ও সঞ্চয়ের সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করে এবং এটি অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিমাপক।
৭। ভোক্তা এবং বিনিয়োগের মধ্যে সম্পর্ক: GDP, GNP এবং অন্যান্য সূচকগুলো ভোক্তা ব্যয় এবং বিনিয়োগের মধ্যে সম্পর্ক স্থাপন করে। যখন জনগণের ব্যয়যোগ্য আয় (DI) বৃদ্ধি পায়, তখন তাদের ভোগের পরিমাণও বাড়ে, যা অর্থনীতিকে চাঙ্গা করে। একই সাথে, যদি মানুষ তাদের DI-এর একটি অংশ সঞ্চয় করে, তবে সেই সঞ্চয় বিনিয়োগে রূপান্তরিত হয়, যা ভবিষ্যতের উৎপাদনশীলতা বাড়াতে সাহায্য করে। এভাবে, এই সূচকগুলো অর্থনৈতিক চক্রের প্রতিটি ধাপকে সংযুক্ত করে।
৮। বৈদেশিক বাণিজ্য এবং অর্থনীতির উপর প্রভাব: GDP এবং GNP-এর তুলনা করে একটি দেশের বৈদেশিক বাণিজ্যের প্রভাব বোঝা যায়। যদি GDP-এর চেয়ে GNP বেশি হয়, তবে এর অর্থ হলো দেশের নাগরিকরা বিদেশ থেকে বেশি আয় করছে। বিপরীতভাবে, যদি GNP-এর চেয়ে GDP বেশি হয়, তবে এর অর্থ হলো বিদেশি কোম্পানিগুলো দেশ থেকে বেশি আয় করছে। এই সম্পর্ক একটি দেশের বাণিজ্য ভারসাম্যের চিত্র তুলে ধরে এবং অর্থনৈতিক নীতি নির্ধারণে সহায়তা করে।
উপসংহার: GDP, GNP, NNP, NI, PI এবং DI-এর মতো এই অর্থনৈতিক সূচকগুলো একটি দেশের অর্থনৈতিক স্বাস্থ্য, কর্মক্ষমতা এবং জনগণের জীবনযাত্রার মান মূল্যায়নের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই ধারণাগুলো একে অপরের সাথে সম্পর্কযুক্ত এবং সামগ্রিকভাবে একটি দেশের অর্থনীতির একটি সম্পূর্ণ চিত্র প্রদান করে। এসব সূচক বিশ্লেষণ করে সরকার অর্থনৈতিক নীতি প্রণয়ন করে এবং নীতিনির্ধারকরা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে। এই সূচকগুলো একটি দেশের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করে।
- GDP: একটি দেশের অর্থনৈতিক পরিধি
- GNP: দেশীয় নাগরিকদের উৎপাদন
- NNP: মূলধন অবচয় বাদ দিয়ে
- NI: প্রকৃত জাতীয় আয়
- PI: ব্যক্তিগত আয়
- DI: প্রকৃত ব্যবহারযোগ্য আয়
- ভোক্তা এবং বিনিয়োগের মধ্যে সম্পর্ক
- বৈদেশিক বাণিজ্য এবং অর্থনীতির উপর প্রভাব
১৯৩৪ সালে সাইমন কুজনেটসের নেতৃত্বে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় অর্থনীতিতে GDP-এর ধারণা প্রথম ব্যবহৃত হয়। এরপর ১৯৪৫ সালে ব্রেটন উডস কনফারেন্সে এটি বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক বিশ্লেষণের প্রধান মানদণ্ড হিসেবে স্বীকৃতি পায়। ১৯৮৫ সালে জাতিসংঘের একটি জরিপে দেখা যায়, প্রায় ১৫৮টি দেশ জিডিপি ব্যবহার করে তাদের অর্থনৈতিক অগ্রগতি পরিমাপ করে। এটি অর্থনীতিতে একটি বৈপ্লবিক পরিবর্তন নিয়ে আসে।

