- readaim.com
- 0
উত্তর::ভূমিকা: অর্থনীতির দুটি গুরুত্বপূর্ণ বাজার কাঠামো হলো অলিগোপলি এবং ডুয়োপলি। এই দুটি ধারণা বোঝা আমাদের জন্য জরুরি, কারণ এগুলি বাস্তব বিশ্বের বিভিন্ন শিল্প এবং বাজারের গতিবিধি ব্যাখ্যা করতে সাহায্য করে। এই নিবন্ধে, আমরা সহজ ও আকর্ষণীয় ভাষায় অলিগোপলি এবং ডুয়োপলির ধারণা নিয়ে আলোচনা করব এবং দেখব কীভাবে তারা বাজারের ওপর প্রভাব ফেলে।
১। অলিগোপলি বাজার: অলিগোপলি হলো এমন একটি বাজার যেখানে অল্প কয়েকটি বৃহৎ ফার্ম বা বিক্রেতা একটি নির্দিষ্ট পণ্য বা পরিষেবা সরবরাহ করে। এই অল্প সংখ্যক বিক্রেতার সংখ্যা এত কম যে, তাদের প্রত্যেকেই বাজারের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ নিয়ন্ত্রণ করে। প্রতিটি ফার্মের সিদ্ধান্ত, যেমন দাম নির্ধারণ বা উৎপাদন পরিবর্তন, সরাসরি অন্যান্য ফার্মের ওপর প্রভাব ফেলে। তাই, এই ফার্মগুলো একে অপরের প্রতি খুবই সংবেদনশীল এবং তাদের মধ্যে প্রায়শই কৌশলগত মিথস্ক্রিয়া দেখা যায়। উদাহরণস্বরূপ, মোবাইল ফোন পরিষেবা, বিমান পরিবহন বা গাড়ির বাজারকে অলিগোপলির উদাহরণ হিসেবে দেখানো যেতে পারে।
২। ডুয়োপলি বাজার: ডুয়োপলি হলো অলিগোপলির একটি বিশেষ রূপ, যেখানে শুধুমাত্র দুটি ফার্ম বা বিক্রেতা বাজারে বিদ্যমান থাকে। এই দুটি ফার্মই পুরো বাজারের ওপর একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ রাখে। ডুয়োপলিতে ফার্মগুলোর মধ্যে পারস্পরিক নির্ভরশীলতা সবচেয়ে বেশি থাকে। তাদের মধ্যেকার প্রতিদ্বন্দ্বিতা বা সহযোগিতা বাজারের দাম, সরবরাহ এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোকে সরাসরি প্রভাবিত করে। যেমন, দুটি সফট ড্রিংক কোম্পানি বা দুটি মোবাইল অপারেটর কোম্পানি যখন কোনো নির্দিষ্ট বাজারে নিজেদের আধিপত্য বিস্তার করে, তখন তাকে ডুয়োপলি বলা যেতে পারে। এই ধরনের বাজারে ফার্মগুলোর মধ্যেকার কৌশলগত সম্পর্ক খুবই জটিল হয়।
৩। ফার্মের সংখ্যা: অলিগোপলি এবং ডুয়োপলির মূল পার্থক্য হলো ফার্মের সংখ্যা। অলিগোপলিতে বিক্রেতার সংখ্যা অল্প হলেও দুইয়ের অধিক হতে পারে, যেমন ৩, ৪, বা ৫টি। অন্যদিকে, ডুয়োপলিতে বিক্রেতার সংখ্যা নির্দিষ্টভাবে দুটি। এই সংখ্যার পার্থক্য তাদের মধ্যেকার প্রতিদ্বন্দ্বিতা এবং পারস্পরিক নির্ভরশীলতার মাত্রাকে প্রভাবিত করে। অলিগোপলিতে যেখানে একাধিক ফার্মের মধ্যে জটিল কৌশল দেখা যায়, সেখানে ডুয়োপলিতে দুটি ফার্মের মধ্যেকার সম্পর্ক আরও সরাসরি এবং স্পষ্ট হয়।
৪। বাজার নিয়ন্ত্রণ: উভয় বাজারেই বিক্রেতারা বাজারের ওপর যথেষ্ট নিয়ন্ত্রণ রাখে। তবে, অলিগোপলিতে অল্প সংখ্যক ফার্ম মিলে বাজার নিয়ন্ত্রণ করে, যেখানে ডুয়োপলিতে দুটি ফার্মই পুরো বাজারের ওপর প্রায় সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ রাখে। এই ধরনের বাজারে নতুন কোনো ফার্মের প্রবেশ করা খুবই কঠিন, কারণ বিদ্যমান ফার্মগুলো তাদের অবস্থান শক্তিশালী করার জন্য বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে, যেমন দাম কমিয়ে দেওয়া বা বড় আকারের বিজ্ঞাপন প্রচার করা।
৫। প্রতিযোগিতার ধরণ: অলিগোপলি এবং ডুয়োপলিতে দামের প্রতিযোগিতা প্রায়শই কম হয়, কারণ ফার্মগুলো বুঝতে পারে যে দাম কমালে অন্যরাও দাম কমিয়ে দেবে, যা সবার লাভ কমিয়ে দেবে। তাই তারা দামের পরিবর্তে অন্যান্য বিষয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে, যেমন পণ্যের মান, ডিজাইন, বিজ্ঞাপন এবং বিক্রয়োত্তর সেবা। একে অ-মূল্য প্রতিযোগিতা বলা হয়। এই কৌশলগুলো ব্যবহার করে ফার্মগুলো তাদের বাজার অংশীদারিত্ব বাড়ানোর চেষ্টা করে।
৬। পারস্পরিক নির্ভরশীলতা: এই দুটি বাজার কাঠামোর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো ফার্মগুলোর মধ্যেকার উচ্চ মাত্রার পারস্পরিক নির্ভরশীলতা। একটি ফার্মের কোনো সিদ্ধান্ত, যেমন দাম কমানো বা একটি নতুন পণ্য বাজারে আনা, অন্য ফার্মের প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। এই পারস্পরিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া বাজারের ফলাফলকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করে। এই কারণে, ফার্মগুলো প্রায়শই একে অপরের কৌশল পর্যবেক্ষণ করে এবং সেই অনুযায়ী নিজেদের পরিকল্পনা সাজায়।
৭। কার্টেল গঠন: অলিগোপলিতে ফার্মগুলো প্রায়শই একত্রিত হয়ে একটি কার্টেল গঠন করতে পারে, যেখানে তারা দাম নির্ধারণ বা উৎপাদনের পরিমাণ নিয়ে গোপন চুক্তি করে। এর ফলে তারা একচেটিয়া বাজারের মতো আচরণ করতে পারে এবং উচ্চ মুনাফা লাভ করতে পারে। ডুয়োপলিতেও দুটি ফার্মের মধ্যে এমন গোপন চুক্তি হতে পারে, যা গ্রাহকদের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। যদিও বেশিরভাগ দেশেই এই ধরনের কার্টেল বা গোপন চুক্তি অবৈধ।
৮। বাজারের প্রবেশ বাধা: উভয় বাজারেই নতুন ফার্মের প্রবেশ করা কঠিন। এর কারণ হতে পারে উচ্চ বিনিয়োগের প্রয়োজন, বিদ্যমান ফার্মগুলোর ব্র্যান্ডের শক্তিশালী অবস্থান, বা সরকারি নীতি। এসব বাধা নতুন প্রতিযোগীদের নিরুৎসাহিত করে এবং বিদ্যমান ফার্মগুলোর আধিপত্য বজায় রাখতে সাহায্য করে। এর ফলে বাজারে নতুনত্ব ও প্রতিযোগিতার অভাব দেখা দিতে পারে, যা দীর্ঘমেয়াদে গ্রাহকদের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে।
৯। উদাহরণ: অলিগোপলির উদাহরণ হিসেবে আমরা মোবাইল ফোন পরিষেবা প্রদানকারী কোম্পানি (যেমন, বাংলাদেশে গ্রামীণফোন, রবি, বাংলালিংক) বা গাড়ির শিল্পকে (যেমন, টয়োটা, হোন্ডা, ফোর্ড) দেখতে পারি। অন্যদিকে, ডুয়োপলির উদাহরণ হিসেবে কোকা-কোলা এবং পেপসি’র মধ্যেকার বৈশ্বিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা বা কোনো নির্দিষ্ট দেশে দুটি বৃহৎ সিমেন্ট কোম্পানির মধ্যেকার বাজারকে বিবেচনা করা যেতে পারে। এই উদাহরণগুলো বাস্তব বিশ্বে এই বাজার কাঠামোগুলোর কার্যকারিতা বুঝতে সাহায্য করে।
উপসংহার: অলিগোপলি এবং ডুয়োপলি উভয়ই এমন বাজার কাঠামো যেখানে অল্প সংখ্যক বিক্রেতা বাজারের ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখে। তাদের মধ্যেকার পারস্পরিক নির্ভরশীলতা এবং কৌশলগত আচরণ এই বাজারগুলোর গতিবিধিকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করে। এই বাজার কাঠামো সম্পর্কে ধারণা রাখা আমাদের জন্য জরুরি, কারণ এটি আমাদের দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহৃত অনেক পণ্য ও সেবার দাম এবং মানের কারণ ব্যাখ্যা করতে সাহায্য করে।
- ⚪ অলিগোপলি বাজার
- ⚪ ডুয়োপলি বাজার
- ⚪ ফার্মের সংখ্যা
- ⚪ বাজার নিয়ন্ত্রণ
- ⚪ প্রতিযোগিতার ধরণ
- ⚪ পারস্পরিক নির্ভরশীলতা
- ⚪ কার্টেল গঠন
- ⚪ বাজারের প্রবেশ বাধা
- ⚪ উদাহরণ
এই বাজারগুলোর উৎপত্তি ও বিবর্তন বহুলাংশে ইতিহাসের সাথে জড়িত। ১৯১১ সালে আমেরিকান টোব্যাকো কোম্পানিকে যখন ভেঙে দেওয়া হয়, তখন এটি একটি ডুয়োপলি বাজারে পরিণত হয়। এছাড়াও, ১৯৫৬ সালে আইবিএম এবং ১৯৪৮ সালে এটি&টি-এর মতো সংস্থাগুলোর বিরুদ্ধে মামলাগুলো অলিগোপলির আচরণ পরীক্ষা করার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক ঘটনা। ১৯৯০-এর দশকে ইন্টারনেট এবং তথ্য প্রযুক্তির উত্থান নতুন ধরণের অলিগোপলি তৈরি করেছে, যেমন গুগল এবং মেটার মতো প্রযুক্তি সংস্থাগুলো, যা আজকের বৈশ্বিক অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।

