- readaim.com
- 0
উত্তর::ভূমিকা: প্রতিদিন আমরা অসংখ্য দ্রব্য ও সেবা ভোগ করি, যেমন – খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা ইত্যাদি। এই দ্রব্য ও সেবাগুলোর মাধ্যমে আমাদের কোনো না কোনো অভাব পূরণ হয়। অর্থনীতিতে, কোনো জিনিসের মানুষের অভাব পূরণের এই ক্ষমতাকেই একটি বিশেষ নামে অভিহিত করা হয়। সহজ কথায়, কোনো দ্রব্য বা সেবার মধ্যে যে অভাব পূরণের ক্ষমতা বিদ্যমান থাকে, তাকেই আমরা উপযোগ বলি। এটি অর্থনীতির একটি মৌলিক ধারণা যা ভোক্তার আচরণ এবং চাহিদা নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
শাব্দিক অর্থ: ‘উপযোগ’ একটি বাংলা শব্দ যার ইংরেজি প্রতিশব্দ হলো ‘Utility’। ‘Utility’ শব্দটি ল্যাটিন শব্দ ‘Utilitas’ থেকে উদ্ভূত হয়েছে, যার অর্থ ‘usefulness’ বা প্রয়োজনীয়তা। সুতরাং, শাব্দিক অর্থে উপযোগ বলতে কোনো কিছুর প্রয়োজনীয়তা বা ব্যবহারের দক্ষতাকে বোঝায়।
অর্থনীতিতে উপযোগ ধারণাটি আরও ব্যাপক অর্থে ব্যবহৃত হয়। এখানে উপযোগ বলতে কোনো দ্রব্য বা সেবার সেই বিশেষ গুণকে বোঝানো হয়, যা দ্বারা মানুষের অভাব পূরণ করা সম্ভব হয়। কোনো দ্রব্যের উপযোগ আছে বলতে বোঝায় যে, সেই দ্রব্যটির মানুষের অভাব মেটানোর ক্ষমতা রয়েছে। এটি একটি মানসিক ধারণা, যা স্থান, কাল ও পাত্রভেদে পরিবর্তনশীল। উদাহরণস্বরূপ, একজন তৃষ্ণার্ত ব্যক্তির কাছে এক গ্লাস জলের উপযোগ অনেক বেশি, কিন্তু যার তৃষ্ণা নেই তার কাছে এর উপযোগ কম।
অর্থনীতিবিদ, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী এবং সমাজবিজ্ঞানীরা বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে উপযোগের ধারণাটিকে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছেন। তবে অর্থনীতি ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বিভিন্ন গবেষক এর গুরুত্বপূর্ণ সংজ্ঞা প্রদান করেছেন। নিম্নে তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকজনের সংজ্ঞা প্রদান করা হলো-
১। অধ্যাপক মেয়ার্স (Professor Meyers): “উপযোগ হলো কোনো দ্রব্য বা সেবার সেই বিশেষ গুণ বা ক্ষমতা যা মানুষের অভাব পূরণ করতে পারে।” (“Utility is the quality or capacity of a good or service to satisfy human wants.”)
২। অধ্যাপক হিবডন (Professor Hibdon): “উপযোগ হলো কোনো দ্রব্যের সেই ক্ষমতা যা মানুষের অভাব পূরণ করতে বা দূর করতে পারে।” (“Utility is the ability of a good to satisfy a want.”)
৩। অধ্যাপক ওয়াও (Professor Waugh): “উপযোগ হলো কোনো দ্রব্য বা সেবার অভাব পূরণের ক্ষমতা।” (“Utility is the power of a commodity or service to satisfy a want.”)
৪। জেরেমি বেন্থাম (Jeremy Bentham): “উপযোগ হলো কোনো বস্তুর সেই বৈশিষ্ট্য যার মাধ্যমে এটি কোনো সুবিধা, আনন্দ, ভালো বা সুখ উৎপন্ন করার প্রবণতা দেখায় অথবা কোনো ক্ষতি, কষ্ট, মন্দ বা অসুখ প্রতিরোধ করে।” (“Utility is that property in any object, whereby it tends to produce benefit, advantage, pleasure, good, or happiness, or to prevent the happening of mischief, pain, evil, or unhappiness.”)
৫। জন স্টুয়ার্ট মিল (John Stuart Mill): যদিও তিনি বেন্থামের ধারণাকেই প্রসারিত করেছেন, তার মতে উপযোগ কেবল পরিমাণগত নয়, গুণগতও হতে পারে। তিনি উচ্চতর এবং নিম্নতর আনন্দের মধ্যে পার্থক্য করেছেন।
৬। আলফ্রেড মার্শাল (Alfred Marshall): “কোনো দ্রব্যের অভাব মোচনের ক্ষমতাকে উপযোগ বলে।” (“The want satisfying power of a good is called utility.”)
উপরিউক্ত সংজ্ঞাগুলোর আলোকে বলা যায় যে, উপযোগ হলো একটি অনুভূতিগত ধারণা, যা কোনো দ্রব্য বা সেবার वापरा বা ভোগের মাধ্যমে প্রাপ্ত মানসিক তৃপ্তিকে নির্দেশ করে। এটি নৈতিকতা বা বাস্তব কার্যকারিতার উপর নির্ভরশীল নয়। যেমন, সিগারেটের উপযোগ একজন ধূমপায়ীর কাছে থাকলেও তা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর।
উপসংহার: পরিশেষে বলা যায় যে, উপযোগ অর্থনীতির একটি কেন্দ্রীয় ধারণা, যা ছাড়া চাহিদা, ভোগ এবং ভোক্তার আচরণের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো ব্যাখ্যা করা প্রায় অসম্ভব। এটি কোনো দ্রব্যের অন্তর্নিহিত গুণ যা ভোক্তার অভাব পূরণ করে তাকে মানসিক তৃপ্তি প্রদান করে। যদিও এর পরিমাপ করা কঠিন, তবু ভোক্তার সিদ্ধান্ত গ্রহণে এবং বাজারের চাহিদা তৈরিতে এর ভূমিকা অপরিসীম। উপযোগের ধারণা তাই অর্থনৈতিক বিশ্লেষণের জন্য একটি অপরিহার্য হাতিয়ার।
কোনো দ্রব্য বা সেবার মানুষের অভাব পূরণের ক্ষমতাকেই উপযোগ বলে।
উপযোগ ধারণাটি অষ্টাদশ শতকে জেরেমি বেন্থাম ও জন স্টুয়ার্ট মিলের মতো উপযোগবাদী দার্শনিকদের মাধ্যমে জনপ্রিয়তা লাভ করে। পরবর্তীতে, ১৮৭০-এর দশকে ওয়ালরাস, জেভন্স ও মেনজারের মতো নব্য-ধ্রুপদী অর্থনীতিবিদরা “প্রান্তিক উপযোগ তত্ত্ব” (Marginal Utility Theory) বিকাশের মাধ্যমে এর অর্থনৈতিক গুরুত্ব প্রতিষ্ঠা করেন। বিভিন্ন জরিপে দেখা গেছে, ভোক্তার সিদ্ধান্ত গ্রহণে পণ্যের উপযোগ একটি প্রধান নির্ণায়ক হিসেবে কাজ করে, যা বিপণন এবং বিজ্ঞাপনের কৌশল নির্ধারণে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়।

