- readaim.com
- 0
উত্তর::ভূমিকা: কর হলো রাষ্ট্রের আয়ের অন্যতম প্রধান উৎস, যা দিয়ে সরকার দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং জনকল্যাণমূলক কাজ পরিচালনা করে। কোনো প্রকার প্রত্যক্ষ প্রতিদান পাওয়ার আশা ছাড়াই জনসাধারণ রাষ্ট্রকে যে বাধ্যতামূলক আর্থিক অবদান দেয়, তাই কর। এই নিবন্ধে করের কিছু গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য নিয়ে আলোচনা করা হলো।
১।বাধ্যতামূলক অর্থ প্রদান: করের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো এটি জনগণের জন্য বাধ্যতামূলক। সরকার আইন প্রণয়নের মাধ্যমে কর আরোপ করে এবং নাগরিকদের তা মেনে চলতে হয়। কর না দিলে বা কর ফাঁকি দিলে আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ বলে বিবেচিত হয়। এই বাধ্যবাধকতা জনগণের ওপর একটি দায়িত্ব আরোপ করে, যা তাদের দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে সরাসরি অংশ নিতে উৎসাহিত করে। এর মাধ্যমে সরকার দেশের অভ্যন্তরে জরুরি পরিষেবাগুলো, যেমন – স্বাস্থ্য, শিক্ষা এবং নিরাপত্তার মতো গুরুত্বপূর্ণ খাতগুলোতে অর্থায়ন নিশ্চিত করে। কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান যদি কর প্রদানে ব্যর্থ হয়, তাহলে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়, যা কর ব্যবস্থাকে আরও সুসংহত করে।
২।প্রত্যক্ষ প্রতিদান নেই: কর হলো এমন একটি অর্থ প্রদান, যার বিনিময়ে করদাতা সরাসরি কোনো সুবিধা বা প্রতিদান পান না। একজন ব্যক্তি কর প্রদানের পর বলতে পারেন না যে তিনি প্রদত্ত অর্থের বিনিময়ে একটি নির্দিষ্ট সড়ক বা সেবা পেতে চান। যদিও করের মাধ্যমে অর্জিত অর্থ জনকল্যাণমূলক কাজেই ব্যয় হয়, যেমন- রাস্তাঘাট নির্মাণ, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য পরিষেবা প্রদান, কিন্তু এটি নির্দিষ্ট কোনো ব্যক্তির জন্য নয়, বরং সমগ্র সমাজের জন্য। এটি কর ও অন্যান্য শুল্ক, যেমন- টোল বা ফি এর মধ্যে একটি বড় পার্থক্য তৈরি করে, যেখানে সরাসরি সেবার বিনিময়ে অর্থ প্রদান করা হয়। এই বৈশিষ্ট্যটি করকে একটি পরোক্ষ সামাজিক বিনিয়োগ হিসেবে চিহ্নিত করে।
৩।নির্দিষ্টতা ও নিশ্চয়তা: করের আরেকটি অপরিহার্য বৈশিষ্ট্য হলো এর নির্দিষ্টতা। করের পরিমাণ, প্রদানের সময় এবং পদ্ধতি সুনির্দিষ্টভাবে নির্ধারণ করা থাকে। করদাতাকে অবশ্যই জানতে হবে কত পরিমাণ কর দিতে হবে, কখন দিতে হবে এবং কিভাবে তা পরিশোধ করতে হবে। এই নিয়মগুলো সুস্পষ্ট হওয়ায় করদাতাদের মধ্যে কোনো প্রকার অনিশ্চয়তা থাকে না এবং কর ব্যবস্থা স্বচ্ছ ও নির্ভরযোগ্য হয়। সরকার যখন কোনো বাজেট প্রণয়ন করে, তখন কর থেকে প্রাপ্ত আয়ের একটি নির্দিষ্ট অনুমান করতে পারে, যা আর্থিক পরিকল্পনা এবং ব্যয়ের ক্ষেত্রে সহায়তা করে। এই নির্দিষ্টতা সরকারের আর্থিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
৪।সামাজিক কল্যাণ: কর সংগ্রহের মূল উদ্দেশ্য শুধু সরকারের আয় বৃদ্ধি নয়, বরং সামাজিক কল্যাণ সাধন করা। সরকার করের অর্থ ব্যবহার করে দেশের শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, অবকাঠামো উন্নয়ন, দরিদ্রদের জন্য সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি এবং অন্যান্য জনকল্যাণমূলক প্রকল্পগুলো পরিচালনা করে। এর মাধ্যমে সমাজের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে সহায়তা করা হয় এবং অর্থনৈতিক বৈষম্য কমানোর চেষ্টা করা হয়। করের এই বৈশিষ্ট্যটি একটি সুষম ও ন্যায়ভিত্তিক সমাজ গঠনে সহায়তা করে। এই অর্থে কর কেবল একটি আর্থিক লেনদেন নয়, বরং একটি শক্তিশালী সামাজিক হাতিয়ার, যা রাষ্ট্রের উন্নয়ন ও নাগরিকদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে কাজ করে।
৫।অর্থনৈতিক সরঞ্জাম: করকে একটি শক্তিশালী অর্থনৈতিক সরঞ্জাম হিসেবে ব্যবহার করা হয়। সরকার বিভিন্ন ধরনের করের হার বাড়িয়ে বা কমিয়ে অর্থনীতির নির্দিষ্ট দিকগুলোকে প্রভাবিত করতে পারে। যেমন- উচ্চ আয়ের ওপর উচ্চ কর আরোপ করে অর্থনৈতিক বৈষম্য কমানো যায়, আবার নির্দিষ্ট শিল্পে কর ছাড় দিয়ে সেই শিল্পকে উৎসাহিত করা যায়। এর মাধ্যমে সরকার মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, বিনিয়োগ বৃদ্ধি এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে পারে। এই বহুমুখী ব্যবহার করকে শুধু একটি রাজস্ব সংগ্রহের মাধ্যম হিসেবে নয়, বরং একটি দেশের অর্থনৈতিক নীতি নির্ধারণের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। তাই করকে আধুনিক অর্থনীতির একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে গণ্য করা হয়।
৬।ব্যয় নির্বাহ: রাষ্ট্রের প্রধান প্রশাসনিক ও সামরিক ব্যয় নির্বাহের জন্য কর অপরিহার্য। একটি সরকার তার বিশাল প্রশাসনিক কাঠামো, সেনাবাহিনী, পুলিশ বাহিনী এবং বিচার বিভাগের মতো গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যয় মেটাতে করের ওপর নির্ভরশীল। দেশ পরিচালনা, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা এবং জাতীয় নিরাপত্তার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ করের মাধ্যমেই সংগ্রহ করা হয়। এটি ছাড়া কোনো দেশ তার সার্বভৌমত্ব রক্ষা করতে বা অভ্যন্তরীণ শান্তি ও শৃঙ্খলা বজায় রাখতে পারবে না। তাই করকে রাষ্ট্রের অস্তিত্ব রক্ষার একটি মৌলিক উপাদান হিসেবে বিবেচনা করা হয়। করের এই বৈশিষ্ট্যটি সরকারকে স্থিতিশীল এবং কার্যকরী থাকতে সাহায্য করে, যা একটি শক্তিশালী জাতি গঠনের জন্য অপরিহার্য।
৭।নমনীয়তা বা স্থিতিস্থাপকতা: কর ব্যবস্থায় নমনীয়তা একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। এর অর্থ হলো, করের হার বা ধরন অর্থনৈতিক পরিবর্তন অনুযায়ী সহজেই পরিবর্তন করা যায়। যখন কোনো দেশের অর্থনীতি বৃদ্ধি পায়, সরকার তখন করের হার বাড়িয়ে আরও বেশি রাজস্ব সংগ্রহ করতে পারে। আবার অর্থনৈতিক মন্দার সময় করের হার কমিয়ে জনগণকে স্বস্তি দেওয়া যেতে পারে। এই নমনীয়তা সরকারকে অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলায় এবং পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে কার্যকরভাবে সাড়া দিতে সাহায্য করে। এটি একটি দেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনাকে আরও দক্ষ ও স্থিতিশীল করে তোলে, যা দীর্ঘমেয়াদী অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য অপরিহার্য।
৮।সাম্য ও ন্যায়বিচার: একটি ভালো কর ব্যবস্থার অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো সাম্য ও ন্যায়বিচার। এর অর্থ হলো, করের বোঝা সমাজের সব শ্রেণির মানুষের ওপর সমানভাবে না পড়ে, বরং তাদের আর্থিক সক্ষমতা অনুযায়ী আরোপিত হয়। যেমন- প্রগতিশীল কর ব্যবস্থায় ধনীরা তাদের আয়ের একটি বড় অংশ কর হিসেবে দেয়, অন্যদিকে দরিদ্রদের ওপর কম করের বোঝা পড়ে। এর ফলে অর্থনৈতিক বৈষম্য হ্রাস পায় এবং সমাজে একটি ভারসাম্য তৈরি হয়। এই বৈশিষ্ট্যটি নিশ্চিত করে যে কর ব্যবস্থা কোনোভাবেই শোষণের মাধ্যম নয়, বরং এটি একটি ন্যায়ভিত্তিক সমাজের ভিত্তি স্থাপন করে। এর মাধ্যমে রাষ্ট্রের সকল নাগরিকের প্রতি সমান আচরণ নিশ্চিত করা হয়।
৯।উৎপাদনশীলতা: একটি দক্ষ কর ব্যবস্থা হতে হলে তা অবশ্যই উৎপাদনশীল হতে হবে। এর অর্থ হলো, যে পরিমাণ কর সংগ্রহ করা হচ্ছে, তা যেন সরকারের ব্যয়ের চেয়ে বেশি হয়। যদি কর সংগ্রহের জন্য অতিরিক্ত ব্যয় করতে হয়, তাহলে সেই কর ব্যবস্থা অলাভজনক। একটি উৎপাদনশীল কর ব্যবস্থা নিশ্চিত করে যে সরকার পর্যাপ্ত পরিমাণে রাজস্ব সংগ্রহ করতে পারছে, যা দিয়ে দেশের উন্নয়নমূলক কাজগুলো সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করা সম্ভব। এই বৈশিষ্ট্যটি কর ব্যবস্থার কার্যকারিতা এবং অর্থনৈতিক দক্ষতা যাচাই করার একটি গুরুত্বপূর্ণ মানদণ্ড। এটি সরকারের আর্থিক স্থিতিশীলতা এবং জনকল্যাণমূলক প্রকল্পগুলোর ধারাবাহিকতা নিশ্চিত করে।
১০।ব্যাপকতা: একটি কর ব্যবস্থার ব্যাপকতা মানে হলো, এটি সমাজের একটি বড় অংশের মানুষকে করের আওতায় নিয়ে আসে। শুধুমাত্র ধনী বা সীমিত কিছু শ্রেণির ওপর কর আরোপ করলে পর্যাপ্ত রাজস্ব সংগ্রহ করা সম্ভব হয় না। একটি কার্যকর কর ব্যবস্থায় বিভিন্ন ধরনের কর, যেমন- আয়কর, ভ্যাট, শুল্ক ইত্যাদি ব্যবহার করে সমাজের সকল শ্রেণির মানুষকে কর জালের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এর ফলে কর থেকে প্রাপ্ত রাজস্বের পরিমাণ বৃদ্ধি পায় এবং সরকারের আর্থিক ভিত্তি আরও শক্তিশালী হয়। এই ব্যাপকতা নিশ্চিত করে যে দেশের উন্নয়নের ব্যয়ভার কিছু নির্দিষ্ট মানুষের ওপর না পড়ে, বরং সমাজের সকল সক্ষম নাগরিকের ওপর সুষমভাবে বন্টিত হয়।
১১।সুবিধাজনক আদায়: কর আদায়ের পদ্ধতি অবশ্যই করদাতার জন্য সুবিধাজনক হতে হবে। কর প্রদানের জন্য সহজ এবং সরল প্রক্রিয়া থাকা উচিত, যাতে করদাতারা কোনো প্রকার জটিলতা ছাড়াই তাদের দায়িত্ব পালন করতে পারেন। যেমন- বেতন থেকে সরাসরি কর কর্তন বা অনলাইন পেমেন্ট সিস্টেমের মতো পদ্ধতিগুলো করদাতাদের জন্য সময় ও শ্রম বাঁচায়। যদি কর প্রদানের প্রক্রিয়া জটিল হয়, তাহলে অনেকেই কর দিতে নিরুৎসাহিত হতে পারেন বা কর ফাঁকি দেওয়ার প্রবণতা বেড়ে যেতে পারে। এই বৈশিষ্ট্যটি কর ব্যবস্থার গ্রহণযোগ্যতা এবং কার্যকারিতা বৃদ্ধি করে, যা সরকারের জন্য আরও বেশি রাজস্ব সংগ্রহে সহায়তা করে।
১২।স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা: একটি ভালো কর ব্যবস্থার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা। সরকারের কর সংগ্রহের পদ্ধতি এবং সেই অর্থ কোথায় ও কিভাবে ব্যয় হচ্ছে, সে সম্পর্কে জনগণের কাছে সুস্পষ্ট তথ্য থাকা উচিত। করের অর্থ কীভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে তা জানার অধিকার জনগণের রয়েছে এবং সরকার সেই বিষয়ে জবাবদিহি করতে বাধ্য। এই স্বচ্ছতা জনগণের মধ্যে সরকারের প্রতি আস্থা তৈরি করে এবং কর ফাঁকির প্রবণতা কমায়। এটি গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় একটি অপরিহার্য বৈশিষ্ট্য, যা সরকারকে তার দায়িত্ব পালনে আরও সতর্ক করে তোলে এবং সুশাসন নিশ্চিত করে।
১৩।কম খরচ: কর সংগ্রহের খরচ তুলনামূলকভাবে কম হওয়া উচিত। যদি কর সংগ্রহে অতিরিক্ত প্রশাসনিক ব্যয় হয়, তাহলে করের মূল উদ্দেশ্য ব্যাহত হয়। একটি দক্ষ কর ব্যবস্থায় কম লোকবল এবং প্রযুক্তি ব্যবহার করে কম খরচে বেশি রাজস্ব সংগ্রহ করা সম্ভব। এর ফলে কর থেকে প্রাপ্ত অর্থের একটি বড় অংশ জনকল্যাণমূলক কাজে ব্যয় করা যায়। এই বৈশিষ্ট্যটি কর ব্যবস্থার অর্থনৈতিক দক্ষতা নিশ্চিত করে এবং সরকারকে তার আর্থিক সম্পদ আরও কার্যকরভাবে ব্যবহার করতে সাহায্য করে। তাই কর প্রশাসনের দক্ষতা একটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
১৪।স্থায়িত্ব: একটি কর ব্যবস্থা স্থিতিশীল হওয়া উচিত, যার অর্থ হলো করের নিয়ম ও হার ঘন ঘন পরিবর্তন করা উচিত নয়। যদি কর নীতি বারবার পরিবর্তিত হয়, তাহলে ব্যবসায়ী ও বিনিয়োগকারীদের মধ্যে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়, যা অর্থনৈতিক কার্যকলাপকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে। একটি স্থিতিশীল কর ব্যবস্থা দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা এবং বিনিয়োগের জন্য একটি অনুকূল পরিবেশ তৈরি করে। এর ফলে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি স্থিতিশীল থাকে। এই স্থায়িত্ব কর ব্যবস্থার বিশ্বাসযোগ্যতা বৃদ্ধি করে এবং দেশীয় ও বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আকর্ষণ করে, যা দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
১৫।বৈশ্বিক সামঞ্জস্য: আধুনিক বিশ্বে কর ব্যবস্থা শুধু একটি দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় নয়, বরং আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটেও এর সামঞ্জস্য থাকা প্রয়োজন। বিভিন্ন দেশের কর নীতিগুলোর মধ্যে সমন্বয় থাকলে আন্তর্জাতিক ব্যবসা ও বিনিয়োগ সহজ হয়। আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও আর্থিক লেনদেনের ক্ষেত্রে দ্বৈত কর পরিহার করার জন্য বিভিন্ন দেশের মধ্যে কর চুক্তি সম্পাদিত হয়। এই বৈশিষ্ট্যটি বিশ্ব অর্থনীতির সঙ্গে একটি দেশের অর্থনীতির একীকরণকে সহজ করে তোলে এবং আন্তর্জাতিক লেনদেনকে আরও দক্ষ করে। এটি বৈশ্বিক অর্থনীতির একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ, যা বহুরাষ্ট্রীয় কোম্পানিগুলোর কার্যক্রমকে মসৃণ করে।
আমাদের সমাজে কর ব্যবস্থা একটি অপরিহার্য অংশ। দেশের উন্নয়ন, জনকল্যাণ এবং সরকারি ব্যয় নির্বাহের জন্য এটি একটি প্রধান উৎস। এই কর ব্যবস্থা সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য কিছু নির্দিষ্ট আইনকানুন রয়েছে, যা করের কানুন নামে পরিচিত। এই কানুনগুলো নাগরিকদের কর প্রদানের প্রক্রিয়াকে সহজ ও সুশৃঙ্খল করে তোলে।
আয়কর অধ্যাদেশ: বাংলাদেশে আয়কর সংক্রান্ত প্রধান আইন হলো আয়কর অধ্যাদেশ, ১৯৮৪। এই আইনে ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের আয়ের উপর কর আরোপের নিয়মাবলী বিস্তারিতভাবে উল্লেখ করা আছে। করের হার, করমুক্ত আয়সীমা, কর নির্ধারণের পদ্ধতি এবং কর ফাঁকি রোধের ব্যবস্থা সবই এই অধ্যাদেশে লিপিবদ্ধ আছে। এটি করদাতাদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশিকা।
মূল্য সংযোজন কর ও সম্পূরক শুল্ক আইন: মূল্য সংযোজন কর (VAT) হলো পণ্য ও সেবার উপর আরোপিত একটি পরোক্ষ কর। এটি মূল্য সংযোজন কর ও সম্পূরক শুল্ক আইন, ২০১২ দ্বারা পরিচালিত হয়। এই আইন অনুসারে, উৎপাদন থেকে শুরু করে চূড়ান্ত ভোক্তা পর্যন্ত প্রতিটি স্তরে পণ্যের মূল্যের উপর নির্দিষ্ট হারে ভ্যাট আরোপিত হয়। এটি একটি বহুল প্রচলিত কর ব্যবস্থা যা রাজস্ব বৃদ্ধিতে সহায়ক।
আমদানি ও রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ আইন
আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের উপর কর আরোপের জন্য আমদানি ও রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ আইন ব্যবহার করা হয়। এই আইনের অধীনে আমদানি শুল্ক ও রপ্তানি শুল্ক আরোপ করা হয়। এটি দেশের অভ্যন্তরীণ শিল্পকে সুরক্ষা প্রদান এবং বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ন্ত্রণ করতে সহায়ক। এই করের মাধ্যমে সরকার বাণিজ্য ঘাটতি নিয়ন্ত্রণ ও রাজস্ব আয় বৃদ্ধি করে থাকে।
সম্পত্তি কর আইন: বিভিন্ন ধরনের স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তির উপর আরোপিত করকে সম্পত্তি কর বলা হয়। এর মধ্যে রয়েছে ভূমি কর, গৃহ কর, ইত্যাদি। এই কর সাধারণত স্থানীয় সরকার কর্তৃক পরিচালিত হয় এবং এর জন্য বিভিন্ন আইন রয়েছে। সম্পত্তি করের মাধ্যমে স্থানীয় সরকারের উন্নয়নমূলক কার্যক্রমের জন্য অর্থ সংগ্রহ করা হয়, যা নাগরিক সুবিধা বৃদ্ধিতে অবদান রাখে।
দান কর আইন: দান কর হলো নির্দিষ্ট সীমার বেশি দান করা হলে তার উপর আরোপিত কর। দান কর আইন, ১৯৯০ এই বিষয়ে বিস্তারিত ব্যাখ্যা প্রদান করে। এই আইন অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান একটি নির্দিষ্ট আর্থিক মূল্যের বেশি সম্পদ অন্য কাউকে দান করলে তার উপর কর দিতে বাধ্য থাকে। এর উদ্দেশ্য হলো সম্পদের সুষ্ঠু বণ্টন নিশ্চিত করা।
এই করের কানুনসমূহ আমাদের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে সুসংগঠিত রাখতে সাহায্য করে। এগুলোর মাধ্যমে সরকার দেশের উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ সংগ্রহ করতে পারে এবং সমাজের বিভিন্ন স্তরে ন্যায় ও সমতা বজায় রাখতে সক্ষম হয়।
উপসংহার: করের এই ১৫টি বৈশিষ্ট্য একটি শক্তিশালী, ন্যায়ভিত্তিক এবং কার্যকর কর ব্যবস্থার ভিত্তি তৈরি করে। কর কেবল সরকারের আয়ের উৎস নয়, বরং এটি একটি শক্তিশালী অর্থনৈতিক ও সামাজিক হাতিয়ার, যা দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা, সামাজিক সাম্য এবং জনকল্যাণমূলক প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নে অপরিহার্য ভূমিকা রাখে। একটি সুপরিকল্পিত ও সুশৃঙ্খল কর ব্যবস্থা একটি উন্নত ও সমৃদ্ধ জাতির ভিত্তি।
🎨 ১। বাধ্যতামূলক অর্থ প্রদান 🌐 ২। প্রত্যক্ষ প্রতিদান নেই ⚖️ ৩। নির্দিষ্টতা ও নিশ্চয়তা 🫂 ৪। সামাজিক কল্যাণ 📈 ৫। অর্থনৈতিক সরঞ্জাম 🛡️ ৬। ব্যয় নির্বাহ 🔄 ৭। নমনীয়তা বা স্থিতিস্থাপকতা 🤝 ৮। সাম্য ও ন্যায়বিচার 💰 ৯। উৎপাদনশীলতা 🗺️ ১০। ব্যাপকতা ⚙️ ১১। সুবিধাজনক আদায় 🔎 ১২। স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা 📉 ১৩। কম খরচ ⏳ ১৪। স্থায়িত্ব 🌍 ১৫। বৈশ্বিক সামঞ্জস্য।
প্রাচীন মিশর থেকে আধুনিক যুগ পর্যন্ত করের ইতিহাস বেশ পুরোনো। খ্রিষ্টপূর্ব ২০০০ অব্দে মিশরে কৃষি ফসলের ওপর কর আরোপের প্রমাণ পাওয়া যায়। রোমান সাম্রাজ্যেও কর ছিল রাজস্বের প্রধান উৎস, যা দিয়ে বিশাল সামরিক বাহিনী এবং সাম্রাজ্যের অবকাঠামো পরিচালিত হতো। ভারতে মৌর্য ও গুপ্ত সাম্রাজ্যেও বিভিন্ন ধরনের কর প্রচলিত ছিল। ১৭৬৯ সালের ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি দ্বারা ‘দ্বৈত শাসন’ প্রবর্তনের ফলে বাংলার অর্থনীতিতে ব্যাপক পরিবর্তন আসে। ১৯২২ সালে ভারতীয় আয়কর আইন ব্রিটিশ সরকার দ্বারা প্রণীত হয়, যা স্বাধীনতার পরেও কিছু পরিবর্তনসহ বলবৎ ছিল। ১৯৯১ সালে ভারতের অর্থনৈতিক সংস্কারের পর কর ব্যবস্থায় ব্যাপক পরিবর্তন আসে। বর্তমান যুগে, ডিজিটাল লেনদেনের কারণে কর ফাঁকি রোধে অনেক নতুন পদ্ধতি প্রয়োগ করা হচ্ছে, যা কর ব্যবস্থাকে আরও দক্ষ ও স্বচ্ছ করে তুলছে।

