- readaim.com
- 0
উত্তর::ভূমিকা: পূর্ণপ্রতিযোগিতামূলক বাজারে একটি ফার্ম স্বল্পমেয়াদে লোকসানের সম্মুখীন হলেও উৎপাদন কাজ পুরোপুরি বন্ধ করে দেয় না। কারণ, উৎপাদন চালিয়ে গেলে ফার্ম তার পরিবর্তনীয় ব্যয়ের সাথে স্থির ব্যয়ের কিছু অংশ তুলে আনতে পারে, যা উৎপাদন সম্পূর্ণ বন্ধ করে দেওয়ার চেয়ে বেশি লাভজনক। তাই লোকসান সত্ত্বেও উৎপাদন চালু রাখে।
১।স্থির ব্যয় পুনরুদ্ধার: স্বল্পমেয়াদে, ফার্মকে স্থির ব্যয় (যেমন- কারখানার ভাড়া, যন্ত্রপাতির খরচ) বহন করতেই হয়, কিনা উৎপাদন হোক বা না হোক। উৎপাদন চালিয়ে গেলে ফার্ম যদি পরিবর্তনীয় ব্যয়ের অতিরিক্ত কিছু আয় করতে পারে, তবে সেই অতিরিক্ত আয় স্থির ব্যয়ের একটি অংশ তুলে আনতে সাহায্য করে। এতে মোট লোকসানের পরিমাণ কমে আসে।
২।পরিবর্তনীয় ব্যয় মেটানো: যতক্ষণ পর্যন্ত ফার্মের গড় আয় (দাম) গড় পরিবর্তনীয় ব্যয়ের (AVC) চেয়ে বেশি বা সমান থাকে, ততক্ষণ উৎপাদন চালিয়ে যাওয়া যুক্তিসঙ্গত। কারণ, প্রতিটি একক পণ্য বিক্রি করে ফার্ম পরিবর্তনীয় ব্যয়ের পুরোটাই তুলে আনতে পারে। ফলে লোকসান শুধুমাত্র স্থির ব্যয়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে।
৩।উৎপাদন বন্ধের ব্যয়: অনেক সময় উৎপাদন প্রক্রিয়া সাময়িকভাবে বন্ধ এবং পুনরায় চালু করার খরচ অনেক বেশি হতে পারে। এর মধ্যে রয়েছে যন্ত্রপাতি রক্ষণাবেক্ষণ, শ্রমিকদের ছাঁটাই ও পুনরায় নিয়োগের খরচ। এই অতিরিক্ত ব্যয় এড়ানোর জন্য ফার্ম কম লোকসানেও উৎপাদন চালিয়ে যেতে পারে।
৪।বাজারের অংশীদারিত্ব রক্ষা: স্বল্পমেয়াদী লোকসানের কারণে উৎপাদন বন্ধ করে দিলে ফার্ম তার বাজারের অংশীদারিত্ব হারাতে পারে। পরবর্তীতে বাজারে পুনরায় প্রবেশ করা কঠিন এবং ব্যয়বহুল হতে পারে। তাই ভবিষ্যতে টিকে থাকার জন্য এবং গ্রাহক ধরে রাখার জন্য ফার্ম উৎপাদন অব্যাহত রাখে।
৫।ভবিষ্যতের দাম বৃদ্ধির আশা: বাজারের দাম সবসময় পরিবর্তনশীল। ফার্ম আশা করতে পারে যে বর্তমান লোকসান সাময়িক এবং ভবিষ্যতে পণ্যের দাম বাড়তে পারে। এই আশায় তারা লোকসান সত্ত্বেও উৎপাদন চালিয়ে যায়, যাতে দাম বাড়লে দ্রুত মুনাফা অর্জন করা সম্ভব হয়।
৬।শ্রমিক ও সরবরাহকারীদের সম্পর্ক: ফার্মের সাথে দক্ষ শ্রমিক এবং নির্ভরযোগ্য সরবরাহকারীদের একটি দীর্ঘমেয়াদী সম্পর্ক থাকে। উৎপাদন বন্ধ করে দিলে এই সম্পর্ক নষ্ট হতে পারে, যা ভবিষ্যতে বড় ক্ষতির কারণ হবে। তাই সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার স্বার্থে লোকসানেও উৎপাদন চালু রাখা হয়।
৭।সুনাম রক্ষা: একটি ফার্মের সুনাম তার দীর্ঘদিনের কার্যক্রমের ফল। হঠাৎ করে উৎপাদন বন্ধ করে দিলে বাজারে ফার্মের সুনাম ক্ষুণ্ণ হতে পারে এবং গ্রাহকদের আস্থা কমে যেতে পারে। এই সুনাম ধরে রাখার জন্য অনেক সময় লোকসান মেনে নিয়েও উৎপাদন চালিয়ে যাওয়া হয়।
৮।কাঁচামালের চুক্তি: অনেক সময় ফার্ম দীর্ঘমেয়াদে কাঁচামাল কেনার জন্য সরবরাহকারীদের সাথে চুক্তিবদ্ধ থাকে। উৎপাদন বন্ধ করলেও চুক্তি অনুযায়ী কাঁচামাল কিনতেই হয়, যা লোকসানের পরিমাণ আরও বাড়িয়ে দেয়। তাই উৎপাদন চালিয়ে কাঁচামাল ব্যবহার করাটাই শ্রেয়।
৯।প্রাতিষ্ঠানিক বাধ্যবাধকতা: কিছু ক্ষেত্রে, সরকারি নিয়মকানুন বা প্রাতিষ্ঠানিক ঋণের শর্ত অনুযায়ী ফার্ম উৎপাদন বন্ধ করতে পারে না। ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে নেওয়া ঋণের শর্ত থাকতে পারে যে, নির্দিষ্ট পরিমাণ উৎপাদন বজায় রাখতে হবে। এই বাধ্যবাধকতার কারণেও উৎপাদন চালু রাখতে হয়।
১০।শাটডাউন পয়েন্ট: অর্থনীতিতে “শাটডাউন পয়েন্ট” হলো এমন একটি অবস্থা যেখানে দাম (AR) গড় পরিবর্তনীয় ব্যয়ের (AVC) সমান হয়। যতক্ষণ দাম এই বিন্দুর উপরে থাকে, ততক্ষণ উৎপাদন চালিয়ে যাওয়া লাভজনক, যদিও ফার্ম মোট ব্যয়ের হিসাবে লোকসানে থাকতে পারে।
১১।সামাজিক দায়বদ্ধতা: কিছু বড় ফার্ম সামাজিক দায়বদ্ধতার কারণেও উৎপাদন চালিয়ে যায়। হঠাৎ উৎপাদন বন্ধ হয়ে গেলে বহু শ্রমিক বেকার হয়ে পড়ে এবং স্থানীয় অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। এই সামাজিক প্রভাব বিবেচনা করে ফার্ম লোকসানেও উৎপাদন চালু রাখতে পারে।
১২।ব্র্যান্ড ভ্যালু ধরে রাখা: বাজারে ক্রমাগত উপস্থিতি একটি ব্র্যান্ডের পরিচিতি ও মূল্য বাড়িয়ে তোলে। উৎপাদন বন্ধ করলে গ্রাহকদের মন থেকে ব্র্যান্ডটি হারিয়ে যেতে পারে। তাই ব্র্যান্ডের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য স্বল্পমেয়াদী লোকসান সত্ত্বেও উৎপাদন চালিয়ে যাওয়া হয়।
১৩।অভিজ্ঞতা অর্জন: লোকসানের সময়েও উৎপাদন চালিয়ে গেলে ফার্ম বাজার পরিস্থিতি মোকাবেলা করার মূল্যবান অভিজ্ঞতা অর্জন করে। এই অভিজ্ঞতা ভবিষ্যতে ব্যবসায়িক কৌশল নির্ধারণে এবং সংকট মোকাবেলায় সহায়তা করে। এটি এক ধরনের দীর্ঘমেয়াদী বিনিয়োগ হিসেবে কাজ করে।
১৪।প্রযুক্তিগত ধারাবাহিকতা: কিছু শিল্পে, যেমন- রাসায়নিক বা ইস্পাত শিল্পে, উৎপাদন প্রক্রিয়া একবার বন্ধ করলে তা পুনরায় চালু করা অত্যন্ত জটিল ও ব্যয়বহুল। যন্ত্রপাতির ধারাবাহিকতা বজায় রাখার জন্য এবং কারিগরি জটিলতা এড়াতে উৎপাদন চালু রাখা হয়।
১৫।প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা: প্রতিযোগিতামূলক বাজারে টিকে থাকা একটি বড় চ্যালেঞ্জ। যদি একটি ফার্ম লোকসানের ভয়ে উৎপাদন বন্ধ করে, তবে প্রতিযোগীরা সেই সুযোগে বাজারের পুরো নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিতে পারে। তাই প্রতিযোগিতায় নিজের অবস্থান ধরে রাখতে উৎপাদন চালিয়ে যেতে হয়।
১৬।কর্মীদের মনোবল: উৎপাদন বন্ধের সিদ্ধান্ত কর্মীদের মনোবল ভেঙে দিতে পারে। যার ফলে দক্ষ কর্মীরা প্রতিষ্ঠান ছেড়ে চলে যেতে পারেন। কর্মীদের ধরে রাখা এবং তাদের মনোবল অটুট রাখার জন্য ম্যানেজমেন্ট অনেক সময় লোকসানের ঝুঁকি নিয়েও প্রতিষ্ঠান চালু রাখে।
১৭।মূলধনী সম্পদের অপচয় রোধ: উৎপাদন বন্ধ থাকলে কারখানার যন্ত্রপাতি ও অন্যান্য মূলধনী সম্পদের সঠিক ব্যবহার হয় না, যা ধীরে ধীরে সেগুলোর কার্যকারিতা কমিয়ে দেয় এবং অপচয় ঘটায়। এই সম্পদগুলোকে সচল রাখতে এবং অপচয় রোধ করতেও উৎপাদন চালিয়ে যাওয়া হয়।
উপসংহার: সুতরাং, পূর্ণপ্রতিযোগিতামূলক বাজারে একটি ফার্ম স্বল্পমেয়াদে লোকসান দিলেও শুধুমাত্র তাৎক্ষণিক লাভ-ক্ষতির হিসাব করে না। বরং স্থির ব্যয় পুনরুদ্ধার, বাজারের অংশীদারিত্ব, ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা এবং অন্যান্য কৌশলগত দিক বিবেচনা করে উৎপাদন চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়, যা দীর্ঘমেয়াদে ফার্মের অস্তিত্ব রক্ষায় সহায়ক ভূমিকা পালন করে।
🟢 ১। স্থির ব্যয় পুনরুদ্ধার 🔵 ২। পরিবর্তনীয় ব্যয় মেটানো 🟡 ৩। উৎপাদন বন্ধের ব্যয় 🔴 ৪। বাজারের অংশীদারিত্ব রক্ষা 🟣 ৫। ভবিষ্যতের দাম বৃদ্ধির আশা 🟠 ৬। শ্রমিক ও সরবরাহকারীদের সম্পর্ক 🟤 ৭। সুনাম রক্ষা ⚫ ৮। কাঁচামালের চুক্তি ⚪ ৯। প্রাতিষ্ঠানিক বাধ্যবাধকতা 🟦 ১০। শাটডাউন পয়েন্ট 🟩 ১১। সামাজিক দায়বদ্ধতা 🟨 ১২। ব্র্যান্ড ভ্যালু ধরে রাখা 🟥 ১৩। অভিজ্ঞতা অর্জন 🟪 ১৪। প্রযুক্তিগত ধারাবাহিকতা 🟧 ১৫। প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা 🟫 ১৬। কর্মীদের মনোবল ⬛ ১৭। মূলধনী সম্পদের অপচয় রোধ।
পূর্ণপ্রতিযোগিতার ধারণাটি মূলত ১৯ শতকের শেষের দিকে আলফ্রেড মার্শাল এবং লিওন ওয়ালরাসের মতো অর্থনীতিবিদদের লেখার মাধ্যমে প্রসার লাভ করে। “শাটডাউন পয়েন্ট” (Shutdown Point) এর ধারণাটি অর্থনৈতিক তত্ত্বে একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে, যা মূলত স্বল্পমেয়াদী উৎপাদন সিদ্ধান্তের ভিত্তি স্থাপন করে। ১৯৩০-এর দশকের মহামন্দার সময় অনেক ফার্ম লোকসানে থাকা সত্ত্বেও উৎপাদন চালিয়ে গিয়েছিল, কারণ উৎপাদন বন্ধ করার লোকসান ছিল আরও বেশি। বিভিন্ন সময়ের অর্থনৈতিক সংকট, যেমন ২০০৮ সালের বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দা, দেখিয়েছে যে অনেক কোম্পানি টিকে থাকার জন্য লোকসান সত্ত্বেও তাদের কার্যক্রম সীমিত আকারে হলেও চালিয়ে গেছে।

