- readaim.com
- 0
উত্তর::ভূমিকা: বাংলাদেশের অর্থনীতি একটি উন্নয়নশীল এবং গতিশীল অর্থনীতি। স্বাধীনতার পর থেকে নানা প্রতিকূলতা পেরিয়ে দেশটি অর্থনৈতিক অগ্রগতির পথে অবিচলভাবে এগিয়ে চলেছে। কৃষি, শিল্প এবং সেবা খাতের সমন্বয়ে গঠিত এই অর্থনীতিতে দারিদ্র্য বিমোচন, মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন এবং প্রবৃদ্ধি অর্জনের মতো বিষয়গুলো অগ্রাধিকার পাচ্ছে। এর বিশেষ কিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছে, যা এটিকে অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশ থেকে আলাদা করে।
১। কৃষি নির্ভরতা: বাংলাদেশের অর্থনীতি ঐতিহাসিকভাবে কৃষি প্রধান। দেশের জনসংখ্যার একটি বিশাল অংশ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কৃষির ওপর নির্ভরশীল। ধান, পাট, চা, গম এবং বিভিন্ন ধরনের সবজি ও ফলমূল এদেশের প্রধান কৃষিজাত পণ্য। যদিও জিডিপিতে কৃষির অবদান ধীরে ধীরে কমছে, এটি এখনো গ্রামীণ অর্থনীতি, খাদ্য নিরাপত্তা এবং কর্মসংস্থানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। প্রযুক্তি ও আধুনিক চাষাবাদ পদ্ধতির প্রয়োগের ফলে কৃষিখাতে উৎপাদনশীলতা অনেক বেড়েছে, যা দেশের অর্থনীতিকে শক্তিশালী করছে।
২। তৈরি পোশাক শিল্প: তৈরি পোশাক শিল্প বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম প্রধান স্তম্ভ। এটি দেশের রপ্তানি আয়ের সিংহভাগ জোগান দেয় এবং লাখ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করেছে, যার বেশিরভাগই নারী। এই খাতটি আন্তর্জাতিক বাজারে ‘মেইড ইন বাংলাদেশ’ ট্যাগকে একটি নির্ভরযোগ্য ব্র্যান্ড হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছে। এই শিল্পের দ্রুত বিকাশ বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং শিল্পায়নে ব্যাপক অবদান রাখছে, যা দেশকে একটি শিল্প নির্ভর অর্থনীতির দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।
৩। রেমিট্যান্স প্রবাহ: বিদেশে কর্মরত প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য এক বিরাট আশীর্বাদ। এই অর্থ দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়াতে, পরিবারগুলোর জীবনযাত্রার মান উন্নত করতে এবং ভোগ ব্যয় বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। রেমিট্যান্সের এই স্থিতিশীল প্রবাহ দেশের অর্থনীতিকে স্থিতিশীল রাখতে সাহায্য করে এবং গ্রামীণ ও শহুরে উভয় ক্ষেত্রেই উন্নয়নের গতি সঞ্চার করে। এটি দেশের অর্থনৈতিক সক্ষমতা ও স্থিতিস্থাপকতার একটি শক্তিশালী সূচক।
৪। ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প: ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প (SME) বাংলাদেশের অর্থনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এই শিল্পগুলো দেশের কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে, দারিদ্র্য বিমোচনে এবং আঞ্চলিক বৈষম্য কমাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। হস্তশিল্প, তাঁত শিল্প, চামড়া শিল্প এবং বিভিন্ন ধরনের ছোটখাটো উৎপাদনমূলক প্রতিষ্ঠানগুলো এসএমই খাতের প্রধান চালিকাশক্তি। এই খাতটি দেশের গ্রামীণ অর্থনীতির মেরুদণ্ড হিসেবে কাজ করে এবং সামগ্রিক শিল্পায়নকে উৎসাহিত করে।
৫। মানবসম্পদ উন্নয়ন: জনসংখ্যার বিশাল আকারকে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক উন্নয়নের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে। সাক্ষরতার হার বৃদ্ধি, স্বাস্থ্যসেবার উন্নতি এবং প্রযুক্তিগত প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দেশের মানবসম্পদকে আরও দক্ষ করে গড়ে তোলা হচ্ছে। এই বিশাল কর্মক্ষম জনসংখ্যা অভ্যন্তরীণ চাহিদা পূরণ এবং বৈশ্বিক বাজারে প্রতিযোগিতামূলক সুবিধা অর্জনে সহায়তা করছে। দক্ষ জনশক্তি দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত করার জন্য অপরিহার্য।
৬। বৈদেশিক ঋণ ও সহায়তা: বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বৈদেশিক ঋণ ও সহায়তার একটি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রয়েছে। বিভিন্ন উন্নয়নমূলক প্রকল্প যেমন অবকাঠামো নির্মাণ, শিক্ষা এবং স্বাস্থ্যখাতে বিনিয়োগের জন্য আন্তর্জাতিক সংস্থা ও বন্ধু রাষ্ট্রগুলো থেকে এই ঋণ ও সহায়তা আসে। যদিও সরকার অভ্যন্তরীণ সম্পদের উপর নির্ভরতা বাড়ানোর চেষ্টা করছে, এখনো অনেক বড় প্রকল্পের অর্থায়নের জন্য বৈদেশিক সহায়তার প্রয়োজন হয়।
৭। ক্রমবর্ধমান শিল্পায়ন: কৃষি নির্ভর অর্থনীতি থেকে বাংলাদেশ এখন শিল্প নির্ভর অর্থনীতির দিকে যাচ্ছে। পোশাক শিল্পের পাশাপাশি ওষুধ, জাহাজ নির্মাণ, চামড়া, খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ এবং তথ্য প্রযুক্তি খাতের মতো নতুন শিল্পগুলো দ্রুত বিকাশ লাভ করছে। এই শিল্পায়ন প্রক্রিয়া দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধিকে ত্বরান্বিত করছে এবং অর্থনৈতিক কাঠামোতে বৈচিত্র্য আনছে।
৮। তথ্য প্রযুক্তির বিকাশ: সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে তথ্য প্রযুক্তি (আইটি) খাতের বিকাশ অত্যন্ত দ্রুত গতিতে হচ্ছে। ফ্রিল্যান্সিং, সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট এবং কল সেন্টার পরিষেবাগুলো দেশের নতুন আয়ের উৎস হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছে। ডিজিটাল বাংলাদেশ রূপকল্প বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে এই খাতটি দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে নতুন মাত্রা যোগ করছে।
উপসংহার: উপরোক্ত বৈশিষ্ট্যগুলো পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, বাংলাদেশের অর্থনীতি এক মিশ্র এবং পরিবর্তনশীল কাঠামো ধারণ করে আছে। কৃষি থেকে শিল্প ও সেবা খাতের দিকে এই রূপান্তর দেশের অর্থনৈতিক গতিশীলতা ও প্রবৃদ্ধির সাক্ষ্য বহন করে। রেমিট্যান্স, তৈরি পোশাক শিল্প এবং মানবসম্পদ উন্নয়নের মতো খাতগুলো এদেশের অর্থনীতির মেরুদণ্ড হিসেবে কাজ করছে, যা দেশকে সামনের দিকে এগিয়ে নিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করছে।
- কৃষি নির্ভরতা
- তৈরি পোশাক শিল্প
- রেমিট্যান্স প্রবাহ
- ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প
- মানবসম্পদ উন্নয়ন
- বৈদেশিক ঋণ ও সহায়তা
- ক্রমবর্ধমান শিল্পায়ন
- তথ্য প্রযুক্তির বিকাশ
১৯৭১ সালে স্বাধীনতা লাভের পর, যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের অর্থনীতি ছিল প্রায় সম্পূর্ণ কৃষিভিত্তিক। ১৯৭২-৭৩ অর্থবছরে দেশের জিডিপিতে কৃষি খাতের অবদান ছিল প্রায় ৫৯ শতাংশ। সময়ের সাথে সাথে অর্থনৈতিক কাঠামোতে পরিবর্তন আসে। বর্তমানে, সেবা খাত দেশের জিডিপির সিংহভাগ অবদান রাখে। ২০২১-২২ অর্থবছরে বাংলাদেশের জিডিপি প্রথমবারের মতো ৪৫০ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করে, যা দেশটির অর্থনৈতিক উন্নয়নের এক মাইলফলক। এছাড়া, বিভিন্ন জরিপ অনুযায়ী, দারিদ্র্যের হার ১৯৯১ সালে যেখানে ৫৬.৭ শতাংশ ছিল, তা ২০২২ সালে ১৮.৭ শতাংশে নেমে এসেছে।

