- readaim.com
- 0
উত্তর::ভূমিকা: অর্থনীতি হলো মানব জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ, যা সম্পদ ও ভোগের সাথে সম্পর্কিত। অর্থনীতিকে মূলত দুটি প্রধান ভাগে ভাগ করা হয়: ব্যাস্টিক অর্থনীতি (Microeconomics) এবং সামষ্টিক অর্থনীতি (Macroeconomics)। এই দুটি শাখা একে অপরের সাথে সম্পর্কযুক্ত হলেও এদের মধ্যে কিছু মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। ব্যাস্টিক অর্থনীতি একক অর্থনৈতিক এজেন্ট, যেমন ব্যক্তি ও ফার্মের আচরণ নিয়ে কাজ করে, অন্যদিকে সামষ্টিক অর্থনীতি সামগ্রিক অর্থনীতির চিত্র নিয়ে আলোচনা করে। এই নিবন্ধে, আমরা এই দুটি শাখার মধ্যেকার প্রধান পার্থক্যগুলো নিয়ে আলোচনা করব।
১। বিষয়বস্তু: ব্যাস্টিক অর্থনীতির মূল বিষয়বস্তু হলো ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের অর্থনৈতিক আচরণ এবং তাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়া। এর অন্তর্ভুক্ত হলো কোনো একটি নির্দিষ্ট পণ্য বা সেবার দাম নির্ধারণ, বাজারের চাহিদা ও যোগান, এবং উৎপাদন ব্যয়। উদাহরণস্বরূপ, একজন ভোক্তা কীভাবে তার সীমিত আয় দিয়ে বিভিন্ন পণ্য কিনবে বা একটি কোম্পানি কীভাবে তার পণ্যের দাম নির্ধারণ করবে, তা ব্যাস্টিক অর্থনীতির আওতায় পড়ে।
২। পরিধি: সামষ্টিক অর্থনীতির পরিধি অনেক ব্যাপক ও বিস্তৃত। এটি সমগ্র অর্থনীতির সামগ্রিক চিত্র নিয়ে আলোচনা করে, যেমন জাতীয় আয়, বেকারত্ব, মূল্যস্ফীতি, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং দেশের মোট উৎপাদন। সামষ্টিক অর্থনীতির মূল লক্ষ্য হলো সামগ্রিক অর্থনীতির সুস্থতা এবং স্থিতিশীলতা বজায় রাখা। এর আলোচনায় শুধু একটি নির্দিষ্ট বাজার বা ব্যক্তি নয়, বরং একটি দেশের বা পুরো বিশ্বের অর্থনৈতিক অবস্থা অন্তর্ভুক্ত থাকে।
৩। দৃষ্টিকোণ: ব্যাস্টিক অর্থনীতিতে অর্থনৈতিক বিশ্লেষণ করা হয় আংশিক দৃষ্টিকোণ থেকে, অর্থাৎ এটি একটি নির্দিষ্ট খণ্ড বা অংশকে কেন্দ্র করে তার কার্যকারিতা বোঝার চেষ্টা করে। যেমন, একটি নির্দিষ্ট পণ্যের বাজার বিশ্লেষণ বা একটি নির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠানের উৎপাদন প্রক্রিয়া। এটি সামগ্রিক অর্থনীতির বিভিন্ন অংশের মধ্যে সম্পর্ক নিয়ে সরাসরি কাজ করে না, বরং প্রতিটি অংশকে আলাদাভাবে বিশ্লেষণ করে।
৪। লক্ষ্য: সামষ্টিক অর্থনীতির প্রধান লক্ষ্য হলো সামগ্রিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখা। এটি সরকার এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংককে এমন নীতি প্রণয়নে সহায়তা করে যা পুরো অর্থনীতির জন্য কল্যাণকর হয়। এর লক্ষ্য হলো জাতীয় আয় বৃদ্ধি, বেকারত্ব হ্রাস এবং মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা, যা একটি দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির জন্য অপরিহার্য। এটি অর্থনীতির সামগ্রিক চিত্রকে পর্যবেক্ষণ করে এবং সমস্যা সমাধানে কাজ করে।
৫। নীতি: ব্যাস্টিক অর্থনীতিতে ব্যবহৃত নীতিগুলো সাধারণত ক্ষুদ্র-পর্যায়ের নীতি। যেমন, কোনো একটি পণ্যের উপর কর আরোপ বা ভর্তুকি প্রদান করে তার দাম ও চাহিদা নিয়ন্ত্রণ করা। এই নীতিগুলোর প্রভাব সাধারণত সীমিত পরিসরে দেখা যায়। এই নীতিগুলোর মূল উদ্দেশ্য হলো নির্দিষ্ট বাজার বা ফার্মের দক্ষতা বাড়ানো এবং সেখানে বিদ্যমান সমস্যাগুলো সমাধান করা।
৬। চলকসমূহ: সামষ্টিক অর্থনীতিতে ব্যবহৃত চলকসমূহ হলো জাতীয় আয়, মোট দেশজ উৎপাদন (GDP), মূল্যস্ফীতির হার, বেকারত্বের হার, এবং বৈদেশিক বাণিজ্য। এই চলকগুলো সমগ্র অর্থনীতির অবস্থা বোঝার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। উদাহরণস্বরূপ, জিডিপি একটি দেশের মোট অর্থনৈতিক উৎপাদন নির্দেশ করে, যা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির একটি প্রধান সূচক।
৭। সমস্যা সমাধান: ব্যাস্টিক অর্থনীতি মূলত নির্দিষ্ট সমস্যা যেমন – একটি নির্দিষ্ট পণ্যের দাম বৃদ্ধি বা একটি প্রতিষ্ঠানের লোকসান নিয়ে কাজ করে। এটি ব্যক্তি এবং ফার্মের সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করে সমস্যার সমাধান করতে চায়। এই শাখা মূলত বাজারের কার্যকারিতা এবং সম্পদের দক্ষ বন্টনের উপর জোর দেয়।
৮। সম্পর্ক: সামষ্টিক অর্থনীতির সাথে আর্ন্তজাতিক সম্পর্ক খুব ঘনিষ্ঠ। এটি একটি দেশের অর্থনীতি এবং বিশ্বের অন্যান্য দেশের অর্থনীতির মধ্যেকার সম্পর্ক নিয়েও কাজ করে, যেমন বৈদেশিক বাণিজ্য, মুদ্রা বিনিময় হার এবং বিশ্বায়নের প্রভাব। আন্তর্জাতিক বাজার এবং বিভিন্ন দেশের অর্থনৈতিক নীতি কীভাবে একটি দেশের অর্থনীতিকে প্রভাবিত করে তা সামষ্টিক অর্থনীতির আলোচনার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
৯। উৎপাদক এবং ভোক্তা: ব্যাস্টিক অর্থনীতিতে উৎপাদক এবং ভোক্তার পৃথক পৃথক ভূমিকা নিয়ে আলোচনা করা হয়। এখানে ভোক্তা তার সন্তুষ্টি সর্বোচ্চ করতে চায়, অন্যদিকে উৎপাদক তার মুনাফা সর্বোচ্চ করতে চায়। এই দুই পক্ষের আচরণ বিশ্লেষণ করে বাজারের ভারসাম্য এবং দাম নির্ধারণ প্রক্রিয়া বোঝা যায়। এই ভারসাম্য হলো এমন একটি অবস্থা যেখানে চাহিদা ও যোগান সমান হয়।
উপসহার: অর্থনীতির এই দুটি শাখা একে অপরের পরিপূরক। একটি ছাড়া অন্যটির সম্পূর্ণ আলোচনা সম্ভব নয়। ব্যাস্টিক অর্থনীতি সামগ্রিক অর্থনীতির ভিত্তি তৈরি করে, যেখানে প্রতিটি ক্ষুদ্র অংশের আচরণ এবং সিদ্ধান্ত একত্রিত হয়ে বৃহত্তর চিত্র তৈরি করে। অন্যদিকে, সামষ্টিক অর্থনীতি সেই বৃহত্তর চিত্রটি বিশ্লেষণ করে এবং নীতি নির্ধারণ করে যা সকল ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের উপর প্রভাব ফেলে। একটি সফল অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হলে এই দুটি শাখার জ্ঞানই সমান গুরুত্বপূর্ণ।
১. বিষয়বস্তু ২. পরিধি ৩. দৃষ্টিকোণ ৪. লক্ষ্য ৫. নীতি ৬. চলকসমূহ ৭. সমস্যা সমাধান ৮. সম্পর্ক ৯. উৎপাদক এবং ভোক্তা।
অর্থনীতির ব্যাস্টিক ও সামষ্টিক দুটি শাখার ধারণার উৎপত্তি বিশ শতকের প্রথম দিকে। ১৯৩৩ সালে নরওয়েজিয়ান অর্থনীতিবিদ রাগনার ফ্রিশ (Ragnar Frisch) এই দুটি পরিভাষা প্রথম ব্যবহার করেন। এর আগে অর্থনীতিকে সাধারণত কোনো নির্দিষ্ট বিভাজন ছাড়া সামগ্রিকভাবেই অধ্যয়ন করা হতো। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে সামষ্টিক অর্থনীতি আরও বেশি গুরুত্ব পায়, কারণ তখন বিভিন্ন দেশের সরকার অর্থনৈতিক মন্দা ও বেকারত্ব মোকাবেলায় কার্যকর নীতি প্রণয়নের প্রয়োজন অনুভব করে। এই সময়ে জন মেনার্ড কেইনসের “The General Theory of Employment, Interest and Money” (১৯৩৬) বইটি সামষ্টিক অর্থনীতির ভিত্তি হিসেবে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

