- readaim.com
- 0
উত্তর::ভূমিকা: অর্থনীতির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি স্তম্ভ হলো রাজস্বনীতি, যা সরকারের আয় এবং ব্যয়ের সঙ্গে সম্পর্কিত। একটি দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা, প্রবৃদ্ধি এবং সুষম বণ্টন নিশ্চিত করতে এই নীতি অত্যন্ত জরুরি। রাজস্বনীতির হাতিয়ারগুলো সঠিকভাবে ব্যবহার করে সরকার মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, বেকারত্ব হ্রাস এবং অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করার মতো গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্যগুলো অর্জন করতে পারে। সহজ কথায়, এটি এমন একটি কৌশল যা দিয়ে সরকার তার অর্থনৈতিক উদ্দেশ্যগুলো পূরণ করে।
১। সরকারি ব্যয়: রাজস্বনীতির একটি প্রধান হাতিয়ার হলো সরকারি ব্যয়, যার মাধ্যমে সরকার বিভিন্ন খাতে অর্থ খরচ করে। যখন দেশের অর্থনীতি মন্দার দিকে যায়, তখন সরকার রাস্তাঘাট, সেতু, স্কুল-কলেজ, হাসপাতাল, বিদ্যুৎকেন্দ্রের মতো অবকাঠামো নির্মাণে বা বিভিন্ন সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে ব্যয় বাড়ায়। এই ধরনের ব্যয় বৃদ্ধির ফলে মানুষের হাতে টাকা আসে, চাহিদা বাড়ে এবং নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়। এর ফলে অর্থনীতির চাকা আবার সচল হয়ে ওঠে। অন্যদিকে, অর্থনীতিতে অতিরিক্ত চাপ বা মুদ্রাস্ফীতি দেখা দিলে সরকার অপ্রয়োজনীয় ব্যয় হ্রাস করে অর্থনীতিকে শীতল করার চেষ্টা করে।
২। কর আরোপ: কর আরোপ রাজস্বনীতির একটি শক্তিশালী হাতিয়ার, যা দিয়ে সরকার জনগণের কাছ থেকে রাজস্ব সংগ্রহ করে। সরকার বিভিন্ন ধরনের কর যেমন আয়কর, বিক্রয় কর, আমদানি শুল্ক, এবং কর্পোরেট কর ব্যবহার করে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সময় সরকার করের হার বাড়িয়ে অতিরিক্ত রাজস্ব সংগ্রহ করতে পারে, যা দিয়ে তারা জনকল্যাণমূলক প্রকল্পগুলো চালাতে পারে। আবার, মন্দার সময় সরকার করের হার কমিয়ে দেয় যাতে মানুষের কাছে খরচ করার মতো বেশি টাকা থাকে এবং চাহিদা বাড়ে। এর মাধ্যমে অর্থনীতিতে গতিশীলতা আসে।
৩। ভর্তুকি প্রদান: রাজস্বনীতির আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার হলো ভর্তুকি প্রদান। সরকার সাধারণত কোনো পণ্য বা সেবার দাম সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখতে ভর্তুকি দেয়। যেমন, কৃষিখাতে সার বা বীজের দাম কমাতে ভর্তুকি দেওয়া হয় যাতে কৃষকেরা কম খরচে উৎপাদন করতে পারে। এতে পণ্যের দাম কমে এবং সাধারণ মানুষ উপকৃত হয়। জ্বালানি, বিদ্যুৎ বা খাদ্যপণ্যের মতো অত্যাবশ্যকীয় জিনিসের ওপরও সরকার ভর্তুকি দিয়ে থাকে। এর ফলে গরিব ও নিম্ন আয়ের মানুষের জীবনযাত্রা সহজ হয় এবং অর্থনৈতিক বৈষম্য কিছুটা কমে আসে।
৪। সরকারি ঋণ: সরকারি ঋণ হলো আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার, যা দিয়ে সরকার তার ব্যয়ের ঘাটতি পূরণ করে। সরকার যখন তার আয়ের চেয়ে বেশি ব্যয় করতে চায়, তখন তারা দেশীয় বা আন্তর্জাতিক উৎস থেকে ঋণ নেয়। যেমন, সরকার ট্রেজারি বিল বা বন্ড বিক্রি করে জনগণের কাছ থেকে ঋণ নেয়। এই ঋণ ব্যবহার করে সরকার বিভিন্ন উন্নয়নমূলক প্রকল্প বাস্তবায়ন করে। তবে অতিরিক্ত ঋণ দেশের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে পারে, তাই সরকার খুব সতর্কতার সাথে ঋণ নেয়। এটি অর্থনৈতিক গতিশীলতা বজায় রাখতে সাহায্য করে।
৫। বৈদেশিক বাণিজ্য: রাজস্বনীতিতে বৈদেশিক বাণিজ্য একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। সরকার আমদানি ও রপ্তানি শুল্কের মাধ্যমে দেশের অভ্যন্তরীন বাজার এবং শিল্পকে রক্ষা করে। যেমন, সরকার যখন কোনো বিদেশি পণ্যের ওপর উচ্চ শুল্ক আরোপ করে, তখন সেই পণ্যের দাম বেড়ে যায় এবং দেশীয় শিল্প রক্ষা পায়। আবার, সরকার রপ্তানিতে বিভিন্ন প্রণোদনা দিয়ে দেশীয় উৎপাদকদের উৎসাহিত করতে পারে। এর ফলে দেশের রপ্তানি বাড়ে এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বৃদ্ধি পায়। এটি দেশের বাণিজ্য ভারসাম্য রক্ষা করতে সাহায্য করে।
৬। সঞ্চয় নীতি: রাজস্বনীতির আওতায় সরকার সঞ্চয় নীতি প্রণয়ন করে জনগণের মধ্যে সঞ্চয়ের অভ্যাস গড়ে তোলে। সরকার বিভিন্ন সঞ্চয়পত্র, বন্ড, বা পেনশন স্কিম চালু করে। এই ধরনের প্রকল্পগুলোতে সাধারণত উচ্চ সুদ দেওয়া হয়, যা মানুষকে সঞ্চয়ে উৎসাহিত করে। যখন মানুষ বেশি সঞ্চয় করে, তখন ব্যাংকে অর্থের পরিমাণ বাড়ে। এই অর্থ ব্যাংকগুলো বিভিন্ন ব্যবসায় বিনিয়োগ করে, যা দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাড়াতে সাহায্য করে। এর মাধ্যমে সরকার দীর্ঘমেয়াদী উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় পুঁজি সংগ্রহ করতে পারে।
৭। মুদ্রানীতির সমন্বয়: রাজস্বনীতিকে কার্যকর করতে মুদ্রানীতির সাথে সমন্বয় খুবই জরুরি। যেখানে রাজস্বনীতি সরাসরি সরকারের আয়-ব্যয় নিয়ন্ত্রণ করে, সেখানে মুদ্রানীতি কেন্দ্রীয় ব্যাংক দ্বারা পরিচালিত হয় এবং এটি সুদের হার ও অর্থের সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ করে। যখন সরকার মন্দা কাটাতে ব্যয় বাড়ায়, তখন কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুদের হার কমিয়ে অর্থনীতিতে অর্থের সরবরাহ বাড়ায়। এই দুই নীতির মধ্যে সঠিক সমন্বয় না থাকলে অর্থনীতিতে অস্থিতিশীলতা দেখা দিতে পারে। তাই এই দুটি নীতিকে সবসময় একে অপরের পরিপূরক হিসেবে কাজ করতে হয়।
৮। কর ছাড়: রাজস্বনীতির একটি কার্যকরী হাতিয়ার হলো কর ছাড়। সরকার বিভিন্ন খাত বা নির্দিষ্ট শিল্পকে উৎসাহিত করতে কর ছাড় দেয়। যেমন, নতুন প্রযুক্তি শিল্পকে আকর্ষণ করতে বা গ্রামীণ এলাকায় শিল্প স্থাপনে উৎসাহ দিতে সরকার কর ছাড়ের ঘোষণা দিতে পারে। এই কর ছাড়ের ফলে কোম্পানিগুলো নতুন বিনিয়োগে আগ্রহী হয় এবং এর মাধ্যমে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়। এটি দেশের নির্দিষ্ট অঞ্চলের বা নির্দিষ্ট শিল্পের উন্নয়নে সহায়ক ভূমিকা পালন করে এবং অর্থনৈতিক ভারসাম্য রক্ষায় সাহায্য করে।
৯। বাজেট পরিকল্পনা: রাজস্বনীতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি দিক হলো বাজেট পরিকল্পনা। প্রতি বছর সরকার একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য তাদের সম্ভাব্য আয় এবং ব্যয়ের একটি বিস্তারিত পরিকল্পনা তৈরি করে, যাকে বাজেট বলা হয়। এই বাজেটই রাজস্বনীতির মূল ভিত্তি। বাজেটে সরকার নির্ধারণ করে কোন খাতে কত টাকা খরচ হবে, কর থেকে কত টাকা আসবে, এবং ঘাটতি থাকলে তা কীভাবে পূরণ করা হবে। এটি সরকারের অর্থনৈতিক উদ্দেশ্যগুলো অর্জনে একটি সুস্পষ্ট পথনির্দেশিকা হিসেবে কাজ করে।
উপসংহার: রাজস্বনীতি একটি দেশের অর্থনীতির চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করে। এর হাতিয়ারগুলো, যেমন সরকারি ব্যয়, কর, ভর্তুকি, এবং বাজেট পরিকল্পনা, সরকারের অর্থনৈতিক লক্ষ্য পূরণে অপরিহার্য। একটি সুচিন্তিত এবং কার্যকর রাজস্বনীতি একটি দেশকে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, স্থিতিশীলতা, এবং সামাজিক ন্যায়বিচারের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে। তাই, অর্থনীতিকে সঠিক পথে পরিচালনা করার জন্য এই হাতিয়ারগুলো সঠিকভাবে ব্যবহার করা অত্যন্ত জরুরি।
- 💰 সরকারি ব্যয়
- 📊 কর আরোপ
- 🤝 ভর্তুকি প্রদান
- 📈 সরকারি ঋণ
- 🌍 বৈদেশিক বাণিজ্য
- 💾 সঞ্চয় নীতি
- 🔄 মুদ্রানীতির সমন্বয়
- 🎁 কর ছাড়
- 🗓️ বাজেট পরিকল্পনা
রাজস্বনীতির ইতিহাস অনেক পুরোনো, ১৫৯৪ সালে ব্রিটিশ অর্থনীতিবিদ স্যার উইলিয়াম পেটি সর্বপ্রথম এর ধারণা দেন। এরপর ১৯২৯ সালের মহামন্দার পর জন মেনার্ড কেইনস রাজস্বনীতিকে একটি আধুনিক হাতিয়ার হিসেবে তুলে ধরেন। তাঁর মতে, অর্থনৈতিক মন্দা কাটাতে সরকারি ব্যয় বৃদ্ধি একটি কার্যকর উপায়। এই নীতি অনেক দেশেই সফল হয়েছে, যেমন ১৯৩০-এর দশকে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের ‘নিউ ডিল’ কর্মসূচি। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে, ২০১৯ সালের কোভিড-১৯ মহামারীর সময় প্রায় সব দেশই অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে রাজস্বনীতির ব্যাপক ব্যবহার করেছে, যার ফলে সরকারি ব্যয় অপ্রত্যাশিতভাবে বেড়ে গিয়েছিল।

