- readaim.com
- 0
উত্তর::ভূমিকা: পৃথিবীর প্রতিটি দেশই অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের বিভিন্ন স্তরে অবস্থান করে। এই দেশগুলোকে সাধারণত তাদের অর্থনৈতিক অবস্থা, জীবনযাত্রার মান, এবং শিল্পায়নের মাত্রার উপর ভিত্তি করে অনুন্নত এবং উন্নয়নশীল এই দুটি প্রধান শ্রেণিতে ভাগ করা হয়। এই দুটি শ্রেণির মধ্যে স্পষ্ট কিছু পার্থক্য রয়েছে যা একটি দেশের সার্বিক চিত্র তুলে ধরে। এই নিবন্ধে, আমরা সহজ ও আকর্ষণীয় ভাষায় এই দুটি ধরনের দেশের মধ্যে প্রধান পার্থক্যগুলো আলোচনা করব।
১। অর্থনৈতিক ভিত্তি: একটি অনুন্নত দেশের অর্থনীতি সাধারণত কৃষিনির্ভর হয়ে থাকে। তাদের প্রধান অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড হলো কৃষিজ উৎপাদন এবং কাঁচামাল রপ্তানি। শিল্পায়নের হার খুবই কম এবং প্রযুক্তির ব্যবহার সীমিত। অন্যদিকে, একটি উন্নয়নশীল দেশের অর্থনীতিতে কৃষির পাশাপাশি শিল্প ও সেবা খাতের গুরুত্বপূর্ণ অবদান থাকে। এই দেশগুলো শিল্প ও প্রযুক্তির ক্ষেত্রে দ্রুত অগ্রসর হচ্ছে এবং তাদের রপ্তানি তালিকায় তৈরি পণ্য ও সেবা অন্তর্ভুক্ত থাকে।
২। মাথাপিছু আয়: অনুন্নত দেশের মাথাপিছু আয় অত্যন্ত কম থাকে, যা দারিদ্র্যের মূল কারণ। জনগণের জীবনযাত্রার মান নিচু হয় এবং মৌলিক চাহিদা পূরণেও তারা সংগ্রাম করে। এর বিপরীতে, উন্নয়নশীল দেশের মাথাপিছু আয় অপেক্ষাকৃত বেশি হয়, যা অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার ইঙ্গিত দেয়। তাদের জনগণের ক্রয়ক্ষমতা বেশি এবং জীবনযাত্রার মানও উন্নত।
৩। মানব উন্নয়ন: মানব উন্নয়ন সূচক (HDI) অনুন্নত দেশে খুবই নিম্ন হয়। এখানে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার সুযোগ সীমিত এবং অপুষ্টি ও রোগব্যাধি একটি বড় সমস্যা। শিক্ষার হার কম হওয়ায় দক্ষ জনবলের অভাব দেখা যায়। অপরদিকে, উন্নয়নশীল দেশগুলো মানব উন্নয়নে বিনিয়োগ করে এবং শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ও সামাজিক নিরাপত্তা খাতে উন্নতি সাধন করে। ফলস্বরূপ, তাদের জনগণের গড় আয়ু বৃদ্ধি পায় এবং শিক্ষার হার উন্নত হয়।
৪। অবকাঠামো: অনুন্নত দেশগুলোতে যোগাযোগ, বিদ্যুৎ, পানি সরবরাহ এবং অন্যান্য মৌলিক অবকাঠামোর ব্যাপক অভাব দেখা যায়। দুর্বল পরিবহন ব্যবস্থা, বিদ্যুৎ বিভ্রাট, এবং অপর্যাপ্ত পানি সরবরাহ অর্থনৈতিক অগ্রগতির পথে বাধা সৃষ্টি করে। পক্ষান্তরে, উন্নয়নশীল দেশগুলোতে আধুনিক ও উন্নত অবকাঠামো নির্মাণে জোর দেওয়া হয়। উন্নত সড়ক, রেল, বিমানবন্দর, এবং স্থিতিশীল বিদ্যুৎ ও পানি সরবরাহ ব্যবস্থা তাদের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি দ্রুত করে।
৫। প্রযুক্তি ও উদ্ভাবন: প্রযুক্তিগত দিক থেকে অনুন্নত দেশগুলো পিছিয়ে থাকে। তারা পুরনো উৎপাদন পদ্ধতি এবং সীমিত প্রযুক্তি ব্যবহার করে। গবেষণা ও উন্নয়নে বিনিয়োগ প্রায় নেই বললেই চলে। এর বিপরীতে, উন্নয়নশীল দেশগুলো আধুনিক প্রযুক্তি গ্রহণ এবং নিজস্ব উদ্ভাবনী ক্ষমতা বৃদ্ধিতে মনোনিবেশ করে। তারা নতুন প্রযুক্তি ও গবেষণা খাতে বিনিয়োগ করে যা তাদের অর্থনীতিকে আরও গতিশীল করে তোলে।
৬। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা: অনুন্নত দেশগুলোতে প্রায়শই রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, দুর্নীতি, এবং দুর্বল শাসনব্যবস্থা দেখা যায়। এটি বিদেশী বিনিয়োগকে নিরুৎসাহিত করে এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে বাধাগ্রস্ত করে। উন্নয়নশীল দেশগুলো সাধারণত রাজনৈতিকভাবে স্থিতিশীল থাকে এবং সুশাসন প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করে। এই স্থিতিশীলতা বিদেশী বিনিয়োগ আকর্ষণ করে এবং টেকসই উন্নয়নের পরিবেশ তৈরি করে।
৭। বৈদেশিক ঋণ: অনুন্নত দেশগুলো প্রায়শই বৈদেশিক ঋণের উপর নির্ভরশীল থাকে এবং এই ঋণ শোধ করার ক্ষমতা তাদের কম থাকে। ঋণের বোঝা তাদের অর্থনৈতিক স্বাধীনতাকে সীমিত করে। উন্নয়নশীল দেশগুলোও ঋণ গ্রহণ করে, কিন্তু তারা সেই ঋণকে উৎপাদনশীল খাতে বিনিয়োগ করে এবং সময়মতো তা পরিশোধ করার সক্ষমতা রাখে।
৮। শিল্পায়ন ও নগরায়ন: অনুন্নত দেশগুলোতে শিল্পায়ন ও নগরায়নের হার খুবই কম। বেশিরভাগ মানুষ গ্রামে বসবাস করে এবং কৃষি কাজের উপর নির্ভরশীল থাকে। নগরে বসবাসের হার কম হওয়ায় আধুনিক সুযোগ-সুবিধা সীমিত। পক্ষান্তরে, উন্নয়নশীল দেশগুলোতে দ্রুত শিল্পায়ন ও নগরায়ন ঘটছে। বহু মানুষ গ্রাম ছেড়ে শহরে চলে আসছে, যা নতুন কর্মসংস্থান এবং উন্নত জীবনযাত্রার সুযোগ তৈরি করছে।
৯। কর্মসংস্থান: অনুন্নত দেশে কর্মসংস্থান মূলত প্রাথমিক খাতে (কৃষি) সীমাবদ্ধ থাকে। বেকারত্বের হার উচ্চ এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টির সুযোগ কম থাকে। অন্যদিকে, উন্নয়নশীল দেশগুলোতে শিল্প ও সেবা খাতে নতুন নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হচ্ছে, যা বেকারত্বের হার কমাতে সাহায্য করছে। দক্ষ ও অদক্ষ উভয় ধরনের শ্রমিকদের জন্য কাজের সুযোগ বৃদ্ধি পাচ্ছে।
১০। রপ্তানি খাত: অনুন্নত দেশের প্রধান রপ্তানি পণ্য হলো কাঁচামাল, যেমন—খনিজ পদার্থ, কৃষিজ পণ্য ইত্যাদি। এর বাজার মূল্য সাধারণত কম থাকে। অপরদিকে, উন্নয়নশীল দেশগুলো প্রক্রিয়াজাত পণ্য, তৈরি পোশাক, ইলেকট্রনিক্স এবং বিভিন্ন সেবা রপ্তানি করে, যার মূল্য বেশি এবং যা তাদের বৈদেশিক মুদ্রা আয় বাড়াতে সাহায্য করে।
উপসংহার: উন্নয়নশীল এবং অনুন্নত দেশের মধ্যেকার এই পার্থক্যগুলো শুধু অর্থনৈতিক পরিসংখ্যান নয়, বরং জনগণের জীবনযাত্রার মান এবং ভবিষ্যৎ সম্ভাবনার প্রতিফলন। অনুন্নত দেশগুলো বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হলেও তাদের সামনে উন্নয়নশীল দেশে রূপান্তরিত হওয়ার বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে। শিক্ষা, প্রযুক্তি, এবং সুশাসনের মাধ্যমে একটি অনুন্নত দেশ ধীরে ধীরে উন্নয়নের পথে অগ্রসর হতে পারে। এই রূপান্তর প্রক্রিয়া কেবল অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নয়, বরং মানব জীবনের সার্বিক উন্নতিও নিশ্চিত করে।
অর্থনৈতিক ভিত্তি মাথাপিছু আয় মানব উন্নয়ন অবকাঠামো প্রযুক্তি ও উদ্ভাবন রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বৈদেশিক ঋণ শিল্পায়ন ও নগরায়ন কর্মসংস্থান রপ্তানি খাত
ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে, বিশ্বব্যাংক ১৯৫০-এর দশকে প্রথমবারের মতো “উন্নয়নশীল” দেশের ধারণাটি জনপ্রিয় করে। ১৯৯০-এর দশকে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা (WTO) গঠনের পর আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ব্যবস্থা অনুন্নত দেশগুলোকে অর্থনৈতিকভাবে এগিয়ে আসার সুযোগ দেয়। ২০০০ সালে জাতিসংঘের সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (MDGs) এবং ২০১৫ সালে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (SDGs) অনুন্নত দেশগুলোর দারিদ্র্য বিমোচন, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

