- readaim.com
- 0
উত্তর::ভূমিকা: অপরাধ বাণিজ্য হলো এমন একটি অর্থনৈতিক কার্যকলাপ যা বেআইনি এবং অবৈধ উপায়ে পরিচালিত হয়। এটি এমন একটি প্রক্রিয়া যেখানে বিভিন্ন ধরনের অপরাধমূলক কার্যক্রমের মাধ্যমে অর্থ উপার্জন করা হয়। সাধারণ ব্যবসার মতো এটিও লাভজনক, তবে এর সবটাই কালোবাজারি এবং অবৈধ। মানুষের ক্ষতি করে, সমাজকে ধ্বংস করে এবং আইন লঙ্ঘন করে এই ধরনের বাণিজ্য পরিচালিত হয়।
শাব্দিক অর্থ: অপরাধ বাণিজ্য শব্দটি দুটি শব্দের সমন্বয়ে গঠিত: অপরাধ এবং বাণিজ্য। অপরাধ অর্থ হলো আইন ভঙ্গকারী কাজ, আর বাণিজ্য অর্থ হলো কেনাবেচা বা লেনদেন। অর্থাৎ, অপরাধ বাণিজ্য হলো এমন লেনদেন যা আইনবিরুদ্ধ কাজ বা অপরাধের মাধ্যমে পরিচালিত হয়।
অপরাধ বাণিজ্য বলতে কোনো ব্যক্তি, গোষ্ঠী বা প্রতিষ্ঠান দ্বারা পরিচালিত এমন সব অবৈধ অর্থনৈতিক কার্যক্রমকে বোঝায়, যা মুনাফা অর্জনের উদ্দেশ্যে সংঘটিত হয়। এটি মূলত প্রচলিত বাজার ব্যবস্থার বাইরে একটি সমান্তরাল কালোবাজারি অর্থনীতি তৈরি করে। এই বাণিজ্যের মধ্যে মাদক পাচার, মানব পাচার, অস্ত্র পাচার, বন্যপ্রাণী পাচার, জালিয়াতি এবং অর্থ পাচারের মতো গুরুতর অপরাধ অন্তর্ভুক্ত। অপরাধ বাণিজ্য সাধারণত আন্তর্জাতিক সীমানা অতিক্রম করে পরিচালিত হয় এবং এর সাথে অনেক দেশের অপরাধী চক্র জড়িত থাকে।
এখানে কিছু প্রখ্যাত বিজ্ঞানী, গবেষক এবং অধ্যাপকদের দেওয়া অপরাধ বাণিজ্যের সংজ্ঞা তুলে ধরা হলো:
১।রোনাল্ড আক (Ronald Akers): তিনি অপরাধ বাণিজ্যকে এমন একটি অর্থনৈতিক কার্যকলাপ হিসেবে বর্ণনা করেছেন, যেখানে অপরাধমূলক কাজের মাধ্যমে পণ্য বা পরিষেবা কেনাবেচা হয়। (He described illicit trade as an economic activity where goods and services are bought and sold through criminal acts.)
২।পিটার নিউম্যান (Peter Neumann): তার মতে, অপরাধ বাণিজ্য হলো এমন একটি প্রক্রিয়া, যার মাধ্যমে অপরাধী গোষ্ঠীগুলো অবৈধ লেনদেন পরিচালনা করে এবং এর মাধ্যমে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতা অর্জন করে। (According to him, illicit trade is a process through which criminal groups conduct illegal transactions and gain political and economic power.)
৩।কার্ল মার্কস (Karl Marx): যদিও তিনি সরাসরি অপরাধ বাণিজ্য নিয়ে কোনো সংজ্ঞা দেননি, তবে তার “পুঁজিবাদ” তত্ত্বের আলোকে বলা যায়, পুঁজিবাদের অশুভ দিক হিসেবে মুনাফা লাভের জন্য অবৈধ পন্থা অবলম্বন করা হয়, যা অপরাধ বাণিজ্যের জন্ম দেয়। (Although he did not give a direct definition of illicit trade, based on his theory of “Capitalism,” it can be said that in the dark side of capitalism, illegal methods are adopted for profit, which gives rise to illicit trade.)
৪।এমি বেকার (Amy Baker): তিনি অপরাধ বাণিজ্যকে একটি জটিল আন্তঃসীমান্তীয় নেটওয়ার্ক হিসেবে চিহ্নিত করেছেন, যা বিভিন্ন ধরনের অপরাধমূলক কার্যক্রম যেমন অর্থ পাচার, মানব পাচার এবং মাদক পাচারের সাথে জড়িত। (She identified illicit trade as a complex cross-border network involved in various criminal activities such as money laundering, human trafficking, and drug trafficking.)
৫।পল কোহেন (Paul Cohen): তিনি বলেন, অপরাধ বাণিজ্য হলো একটি শৃঙ্খলবদ্ধ বাজার, যেখানে অবৈধ পণ্য উৎপাদন, বিতরণ এবং বিক্রি করা হয়। (He said, illicit trade is a chain-linked market where illegal goods are produced, distributed, and sold.)
৬।ম্যাক্স ভেবার (Max Weber): তিনি সমাজতত্ত্বের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখিয়েছেন যে, অপরাধ বাণিজ্য মূলত সমাজের কাঠামোগত দুর্বলতা ও অসমতার কারণে সৃষ্ট হয়। (From a sociological perspective, he showed that illicit trade primarily arises due to structural weaknesses and inequalities in society.)
৭।এর্নেস্টো সাভোনা (Ernesto Savona): তিনি বলেন, অপরাধ বাণিজ্য হলো একটি সংগঠিত অপরাধ, যা আন্তর্জাতিক আইনের তোয়াক্কা না করে পরিচালিত হয়। (He said, illicit trade is an organized crime that is conducted without regard for international law.)
উপসংহার: উপরের সংজ্ঞাগুলোর আলোকে আমরা বলতে পারি, অপরাধ বাণিজ্য হলো একটি সুসংগঠিত, আন্তঃসীমান্তীয় এবং অবৈধ অর্থনৈতিক কার্যকলাপ, যা মুনাফা অর্জনের উদ্দেশ্যে পরিচালিত হয় এবং এর মাধ্যমে আইন লঙ্ঘন করে সমাজ ও রাষ্ট্রকে ক্ষতিগ্রস্ত করা হয়।
১।অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড: অপরাধ বাণিজ্যের পক্ষের একটি প্রধান যুক্তি হলো এটি অর্থনীতির কিছু খাতে নগদ অর্থের প্রবাহ তৈরি করে। যেমন, মাদক পাচার, অস্ত্র চোরাচালান বা কালোবাজারি পণ্যের লেনদেন প্রচুর পরিমাণে অর্থ উৎপাদন করে যা অনেক সময় স্থানীয় অর্থনীতির কিছু অংশে পরোক্ষভাবে অবদান রাখে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে, এই অবৈধ লেনদেনগুলি কিছু মানুষের জন্য জীবিকার উৎস হিসেবে কাজ করে, বিশেষত যারা দারিদ্র্য এবং বেকারত্বের শিকার। এটি একটি বিতর্কিত বিষয়, তবে অস্বীকার করার উপায় নেই যে এটি একটি বৃহৎ আর্থিক চক্র তৈরি করে।
২।দ্রুত কর্মসংস্থান: অনেক সময় অপরাধ বাণিজ্য এমন মানুষের জন্য দ্রুত কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে যাদের অন্য কোনো বৈধ উপায়ে রোজগারের সুযোগ নেই। অবৈধ মাদক উৎপাদন ও পাচারের সাথে জড়িত ব্যক্তিরা, চোরাচালানি পণ্য বহনকারীরা বা এমনকি ছোটখাটো অপরাধের সাথে যুক্ত মানুষরা তাদের জীবিকা নির্বাহের জন্য এই পথ বেছে নেয়। এই ধরনের কর্মসংস্থান ঝুঁকিপূর্ণ হলেও, এটি তাদের কাছে একটি বিকল্প হিসেবে আসে যখন বৈধ কর্মসংস্থানের সুযোগ সীমিত থাকে।
৩।সীমিত বৈধ বিকল্প: অনেক সময় দেখা যায়, কিছু মানুষ অপরাধের জগতে পা বাড়ায় কারণ তাদের সামনে কোনো বৈধ বিকল্প থাকে না। দারিদ্র্য, শিক্ষার অভাব, সামাজিক বৈষম্য এবং বৈশ্বিক অর্থনীতির চাপ তাদের অপরাধের পথে ঠেলে দেয়। এই অবস্থায়, অপরাধ বাণিজ্য তাদের জন্য একটি সহজ এবং দ্রুত উপার্জনের পথ খুলে দেয়, যা তাদের বেঁচে থাকার জন্য অপরিহার্য হয়ে ওঠে। এর ফলে, তারা দ্রুত অর্থ উপার্জন করতে পারে যা তাদের বর্তমান আর্থিক সংকট থেকে মুক্তি দেয়।
৪।সরকারের অদক্ষতা: কিছু ক্ষেত্রে, অপরাধ বাণিজ্য বৃদ্ধি পায় কারণ সরকার বা আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো সমাজের নির্দিষ্ট কিছু সমস্যার সমাধান করতে ব্যর্থ হয়। যখন একটি নির্দিষ্ট পণ্য বা সেবার চাহিদা থাকে কিন্তু সরকার তার সরবরাহ নিশ্চিত করতে পারে না, তখন অবৈধ বাজার গড়ে ওঠে। যেমন, মাদক বা অস্ত্রের অবৈধ লেনদেন সমাজের চাহিদা পূরণের জন্য একটি বিকল্প পথ তৈরি করে যখন বৈধ পথে তা পাওয়া যায় না।
৫।নতুন প্রযুক্তি: প্রযুক্তি এবং ইন্টারনেটের প্রসারের ফলে অপরাধ বাণিজ্য নতুন রূপ ধারণ করেছে। অনলাইন জুয়া, সাইবার জালিয়াতি, এবং ডিজিটাল মুদ্রার মাধ্যমে অবৈধ লেনদেন অনেক সহজ হয়ে উঠেছে। এই নতুন প্রযুক্তিগুলি অপরাধীদের জন্য নতুন সুযোগ তৈরি করেছে, যা তাদের ধরা পড়ার ঝুঁকি কমিয়ে দিয়েছে। ফলস্বরূপ, এই ধরনের অপরাধ দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং তা মোকাবিলা করা কঠিন হয়ে পড়ছে।
৬।রাজনৈতিক যোগসাজশ: অনেক সময় অপরাধ বাণিজ্য রাজনৈতিক ক্ষমতা ও প্রভাবের সাথে জড়িত থাকে। রাজনৈতিক নেতারা বা প্রভাবশালী ব্যক্তিরা অবৈধ লেনদেন, মাদক পাচার, বা অর্থ পাচার চক্রের সাথে জড়িত থাকে। এই যোগসাজশের কারণে অপরাধীরা প্রায়শই ধরা পড়ে না বা তাদের বিরুদ্ধে আইন প্রয়োগ করা কঠিন হয়ে পড়ে। এই ধরনের পরিস্থিতি অপরাধ বাণিজ্যের বিস্তারকে আরো সহজ করে তোলে।
৭।আন্তর্জাতিক সম্পর্ক: কিছু দেশে অপরাধ বাণিজ্য আন্তর্জাতিক সম্পর্ক এবং ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের উপর নির্ভরশীল। অস্ত্র পাচার, মানব পাচার, এবং মাদক চোরাচালান প্রায়শই সীমান্ত পার হয়ে ঘটে। এই ধরনের অপরাধ আন্তর্জাতিক সম্পর্ককে প্রভাবিত করে এবং দেশগুলোর মধ্যে উত্তেজনা সৃষ্টি করে। কিছু ক্ষেত্রে, এটি একটি দেশ থেকে অন্য দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টির হাতিয়ার হিসেবেও ব্যবহৃত হয়।
৮।সামাজিক চাপ: সমাজের নির্দিষ্ট কিছু অংশ, যেমন যুবসমাজ, দ্রুত অর্থ উপার্জনের লোভে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ে। সামাজিক চাপ, বিলাসবহুল জীবনযাপনের আকাঙ্ক্ষা এবং বন্ধুদের মধ্যে প্রভাব বিস্তারের ইচ্ছা তাদের অপরাধের দিকে ঠেলে দেয়। এই প্রবণতা অনেক সময় বৈধ কাজের চেয়ে দ্রুত ফল দেয়, যা তাদের এই পথে থাকতে উৎসাহিত করে।
৯।আইনের ফাঁক: অনেক দেশের আইন ব্যবস্থায় এমন কিছু ফাঁক থাকে যা অপরাধীরা তাদের সুবিধার জন্য ব্যবহার করে। দুর্বল নজরদারি, অপ্রতুল শাস্তি এবং বিচার প্রক্রিয়ায় দীর্ঘসূত্রিতা অপরাধীদের জন্য নিরাপদ আশ্রয়স্থল তৈরি করে। এই ধরনের আইনি দুর্বলতা অপরাধ বাণিজ্যকে আরো উৎসাহিত করে, কারণ তারা জানে যে ধরা পড়লেও সহজে পার পেয়ে যাবে।
১০।ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট: দীর্ঘকাল ধরে চলে আসা ঐতিহাসিক এবং সাংস্কৃতিক কারণে কিছু সমাজে অপরাধ বাণিজ্য একটি স্বাভাবিক অংশ হয়ে উঠেছে। উদাহরণস্বরূপ, কিছু অঞ্চলে পারিবারিক বা বংশগত পেশা হিসেবে অবৈধ কর্মকাণ্ড চলে আসছে। এই ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট অপরাধ বাণিজ্যের ধারাবাহিকতাকে সমর্থন করে এবং একে সমাজের একটি অংশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে, যা থেকে বের হয়ে আসা কঠিন।
১।নৈতিক ও সামাজিক অবক্ষয়: অপরাধ বাণিজ্য সমাজের নৈতিক এবং সামাজিক কাঠামোর উপর গুরুতর আঘাত হানে। এটি সমাজে অবিশ্বাস, অনৈক্য এবং সহিংসতা বৃদ্ধি করে। যখন অবৈধ কাজকে সহজ উপার্জনের মাধ্যম হিসেবে দেখা হয়, তখন মানুষের মধ্যে ন্যায়নীতি এবং সততার মূল্য কমে যায়। এই নৈতিক অবক্ষয় সামগ্রিকভাবে সমাজের সুস্থ বিকাশের পথে বাধা সৃষ্টি করে।
২।রাষ্ট্রীয় স্থিতিশীলতা নষ্ট: অপরাধ বাণিজ্য রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতার জন্য একটি গুরুতর হুমকি। মাদক চক্র, সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠী এবং অন্যান্য অপরাধী সংগঠনগুলো প্রায়শই রাষ্ট্রের আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে চ্যালেঞ্জ জানায়। এই ধরনের কর্মকাণ্ড সরকারের কার্যকারিতা দুর্বল করে এবং জনমনে নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ সৃষ্টি করে। ফলে, রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব ও জনগণের বিশ্বাস হ্রাস পায়।
৩।অর্থনৈতিক বৈষম্য বৃদ্ধি: অপরাধ বাণিজ্য সমাজে অর্থনৈতিক বৈষম্যকে আরও বাড়িয়ে তোলে। অবৈধ উপায়ে অর্জিত অর্থ অল্প কিছু মানুষের হাতে কেন্দ্রীভূত হয়, যা সাধারণ জনগণের জন্য অর্থনৈতিক সুযোগ সীমিত করে। এই অর্থ কালো অর্থনীতিতে প্রবেশ করে এবং দেশের বৈধ অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এটি সামগ্রিক অর্থনৈতিক উন্নয়নের পথে বাধা সৃষ্টি করে।
৪।জনস্বাস্থ্যের ক্ষতি: মাদক পাচার এবং অবৈধ মদের ব্যবসা জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকি। এই পণ্যগুলো মানুষের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। মাদকাসক্তি এবং এর ফলে সৃষ্ট রোগ সমাজের জন্য একটি বড় বোঝা হয়ে দাঁড়ায়। এটি কেবল ব্যক্তিগত ক্ষতি নয়, বরং একটি দেশের জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থার উপরও চাপ সৃষ্টি করে।
৫।নিরাপত্তার ঝুঁকি: অপরাধ বাণিজ্য দেশের অভ্যন্তরীণ এবং আন্তর্জাতিক নিরাপত্তার জন্য বড় ধরনের ঝুঁকি তৈরি করে। অস্ত্র চোরাচালান এবং মানব পাচার সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িত হতে পারে। এই ধরনের অপরাধ দেশের অভ্যন্তরে সহিংসতা এবং বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে, যা সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রাকে বিঘ্নিত করে। এটি একটি দেশের আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তিও নষ্ট করে।
৬।শিশুদের উপর প্রভাব: অপরাধ বাণিজ্যের সবচেয়ে ভয়াবহ শিকার হলো শিশুরা। অনেক সময় শিশুরা মাদক চক্র, মানব পাচার বা অন্যান্য অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে ব্যবহৃত হয়। তাদের শৈশব ও ভবিষ্যৎ নষ্ট হয়ে যায়। এই শিশুরা কেবল শিকারই হয় না, বরং অনেক সময় তাদের অপরাধমূলক জীবনধারার দিকে ঠেলে দেওয়া হয়, যা সমাজের জন্য একটি দীর্ঘমেয়াদী সমস্যা সৃষ্টি করে।
৭।আইনের প্রতি অবজ্ঞা: যখন অপরাধীরা ধরা পড়ে না বা তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হয় না, তখন মানুষের মধ্যে আইনের প্রতি শ্রদ্ধা কমে যায়। এর ফলে, সাধারণ মানুষও আইন অমান্য করতে উৎসাহিত হয়। এই ধরনের পরিস্থিতি একটি রাষ্ট্রকে একটি বিশৃঙ্খল সমাজে পরিণত করে, যেখানে কোনো নিয়ম-কানুন থাকে না এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর উপর মানুষের আস্থা নষ্ট হয়।
৮।সন্ত্রাসের সাথে যোগসূত্র: অনেক ক্ষেত্রে, অপরাধ বাণিজ্য, বিশেষ করে অস্ত্র ও মাদক পাচার, আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোকে অর্থায়ন করে। এই অর্থ ব্যবহার করে তারা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে, যা বিশ্বব্যাপী শান্তি ও নিরাপত্তার জন্য হুমকি। তাই, অপরাধ বাণিজ্যকে শুধু একটি স্থানীয় সমস্যা হিসেবে দেখা যায় না, বরং এটি একটি বৈশ্বিক সমস্যা হিসেবে বিবেচিত হয়।
৯।শ্রম শোষণ: মানব পাচার এবং অবৈধ অভিবাসন প্রায়শই চরম শ্রম শোষণের সাথে জড়িত। পাচারকারীরা অসহায় মানুষকে লোভ দেখিয়ে বা জোর করে কাজে লাগায় এবং তাদের কোনো মজুরি বা ন্যূনতম সুযোগ-সুবিধা দেয় না। এই ধরনের শোষণ মানব মর্যাদার প্রতি একটি গুরুতর অবমাননা এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের লঙ্ঘন।
১০।পরিবেশের ক্ষতি: কিছু অপরাধ বাণিজ্য, যেমন অবৈধ খনন, বন্যপ্রাণী পাচার এবং অবৈধ বনাঞ্চল ধ্বংস পরিবেশের উপর মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। এই ধরনের কর্মকাণ্ড প্রাকৃতিক সম্পদকে ধ্বংস করে এবং জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি করে। এর ফলে, একটি দেশের প্রাকৃতিক পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হয় এবং দীর্ঘমেয়াদী পরিবেশগত সমস্যা সৃষ্টি হয়।
উপসংহার: অপরাধ বাণিজ্য একটি জটিল এবং বহু-মাত্রিক সমস্যা, যা সমাজের জন্য গুরুতর চ্যালেঞ্জ তৈরি করে। যদিও কিছু ক্ষেত্রে এটি অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বা কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে বলে মনে হতে পারে, এর দীর্ঘমেয়াদী ক্ষতিকর প্রভাব অনেক বেশি। নৈতিক অবক্ষয়, অর্থনৈতিক বৈষম্য, জনস্বাস্থ্যের ক্ষতি এবং রাষ্ট্রের নিরাপত্তার ঝুঁকি – এসবই প্রমাণ করে যে অপরাধ বাণিজ্য কোনো সুস্থ সমাজের জন্য কাম্য নয়।
অপরাধ বাণিজ্য হলো একটি সুসংগঠিত অবৈধ অর্থনৈতিক ব্যবস্থা, যা মুনাফা অর্জনের জন্য আইন ভঙ্গ করে পরিচালিত হয়।
পক্ষে:
১। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড
২। দ্রুত কর্মসংস্থান
৩। সীমিত বৈধ বিকল্প
৪। সরকারের অদক্ষতা
৫। নতুন প্রযুক্তি
৬। রাজনৈতিক যোগসাজশ
৭। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক
৮। সামাজিক চাপ
৯। আইনের ফাঁক
১০। ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট
বিপক্ষে:
১। নৈতিক ও সামাজিক অবক্ষয়
২। রাষ্ট্রীয় স্থিতিশীলতা নষ্ট
৩। অর্থনৈতিক বৈষম্য বৃদ্ধি
৪। জনস্বাস্থ্যের ক্ষতি
৫। নিরাপত্তার ঝুঁকি
৬। শিশুদের উপর প্রভাব
৭। আইনের প্রতি অবজ্ঞা
৮। সন্ত্রাসের সাথে যোগসূত্র
৯। শ্রম শোষণ
১০। পরিবেশের ক্ষতি
ঐতিহাসিকভাবে, অপরাধ বাণিজ্য ১৯২০-এর দশকে আমেরিকার নিষেধকালীন সময়ে (Prohibition era) ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছিল, যখন অ্যালকোহল বিক্রি নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। এর ফলে মাফিয়া এবং অন্যান্য অপরাধী গোষ্ঠীগুলো অবৈধ অ্যালকোহল ব্যবসায় একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে। সাম্প্রতিক সময়ে, ইউনাইটেড নেশনস অফিস অন ড্রাগস অ্যান্ড ক্রাইম (UNODC) এর ২০২১ সালের বৈশ্বিক মাদক রিপোর্ট অনুসারে, বিশ্বের মাদক বাজার প্রায় ৪০০ বিলিয়ন ডলারের বেশি। এটি প্রমাণ করে যে, অপরাধ বাণিজ্য একটি বিশাল অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে পরিণত হয়েছে। আরেকটি ঐতিহাসিক ঘটনা হলো মেক্সিকোর মাদক যুদ্ধ, যা ২০০৬ সাল থেকে শুরু হয়েছিল এবং সেখানে লক্ষাধিক মানুষের মৃত্যু হয়েছে। এই যুদ্ধ দেখায় যে, অপরাধ বাণিজ্য কিভাবে একটি দেশের স্থিতিশীলতা এবং নিরাপত্তা সম্পূর্ণরূপে নষ্ট করতে পারে। এই ধরনের ঘটনাগুলো প্রমাণ করে যে অপরাধ বাণিজ্য কেবল একটি অর্থনৈতিক সমস্যা নয়, বরং এটি একটি গুরুতর সামাজিক এবং রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ।

