- readaim.com
- 0
উত্তর::ভূমিকা: অর্থনীতিতে একচেটিয়া কারবার একটি গুরুত্বপূর্ণ ধারণা, যেখানে একজন বিক্রেতা একটি নির্দিষ্ট পণ্য বা সেবার সম্পূর্ণ বাজার নিয়ন্ত্রণ করে। এই ধরনের বাজারে পণ্যের দাম এবং উৎপাদন নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা বিক্রেতার হাতে থাকে। একচেটিয়া কারবারির মুনাফা সর্বোচ্চ করার জন্য গড় আয় এবং প্রান্তিক আয়ের মধ্যকার সম্পর্ক বোঝা অত্যন্ত জরুরি। এই দুটি ধারণা একে অপরের সঙ্গে কীভাবে সম্পর্কিত, তা নিচে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো।
গড় আয়: গড় আয় বলতে বোঝায়, উৎপাদিত পণ্যের মোট বিক্রয়লব্ধ আয়কে মোট বিক্রীত পণ্যের একক দিয়ে ভাগ করলে যে মান পাওয়া যায়। এটি প্রতিটি একক পণ্যের গড় মূল্য নির্দেশ করে। একচেটিয়া কারবারের ক্ষেত্রে, গড় আয় রেখা (AR) হলো সেই পণ্যের চাহিদা রেখা। এর কারণ হলো, একজন একচেটিয়া বিক্রেতা যখন পণ্যের দাম কমিয়ে দেয়, তখন তার বিক্রির পরিমাণ বাড়ে এবং পুরো বাজারের চাহিদা মিটিয়ে থাকে। এই রেখাটি সাধারণত বাম থেকে ডান দিকে নিম্নগামী হয়, যা বোঝায় যে, বেশি পণ্য বিক্রি করতে হলে দাম কমাতে হবে।
প্রান্তিক আয়: প্রান্তিক আয় হলো অতিরিক্ত এক একক পণ্য বিক্রি করে যে অতিরিক্ত আয় হয়, তার পরিমাণ। এটি মোট আয়ের পরিবর্তনের হার। একচেটিয়া কারবারে পণ্যের দাম কমিয়ে অতিরিক্ত একক বিক্রি করতে হয়, তাই প্রান্তিক আয়ের পরিমাণ গড় আয়ের চেয়ে কম হয়। এর কারণ হলো, অতিরিক্ত একক বিক্রি করতে গিয়ে যখন দাম কমানো হয়, তখন পূর্বের এককগুলোর আয়ও কমে যায়। এই কারণে, প্রান্তিক আয় রেখা (MR) গড় আয় রেখা (AR) এর নিচে অবস্থান করে এবং এর চেয়ে দ্রুত হ্রাস পায়।
১। গড় আয় ও দাম: একটি একচেটিয়া বাজারে, গড় আয় বলতে মোট আয়কে উৎপাদিত পণ্যের পরিমাণ দিয়ে ভাগ করে পাওয়া যায়। একচেটিয়া কারবারির ক্ষেত্রে, গড় আয় প্রায়শই পণ্যের দামের সমান হয়। কারণ, সে একাই বাজারের একমাত্র বিক্রেতা এবং তার বিক্রি করা প্রতিটি ইউনিট থেকে প্রাপ্ত আয় তার গড় আয় নির্ধারণ করে। ফলে, যখন সে পণ্যের দাম কমায়, তখন তার গড় আয়ও কমতে থাকে, যা দামের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত।
২। প্রান্তিক আয়: প্রান্তিক আয় হলো একটি অতিরিক্ত ইউনিট পণ্য বিক্রি করে যে বাড়তি আয় অর্জিত হয়। একচেটিয়া কারবারির ক্ষেত্রে, প্রান্তিক আয় সবসময় গড় আয়ের চেয়ে কম হয়। এর কারণ হলো, অতিরিক্ত পণ্য বিক্রি করার জন্য বিক্রেতাকে পণ্যের দাম কমাতে হয়। এই দাম কমানোর প্রভাব শুধু অতিরিক্ত ইউনিটের উপর নয়, বরং পূর্ববর্তী সব ইউনিটের উপরও পড়ে, যা প্রান্তিক আয়কে গড় আয়ের নিচে নিয়ে আসে।
৩। প্রান্তিক আয় বনাম দাম: একচেটিয়া কারবারিতে, প্রান্তিক আয় সবসময় পণ্যের দামের চেয়ে কম হয়। দাম কমানোর মাধ্যমে অতিরিক্ত পণ্য বিক্রি করতে হয়, যার ফলে পূর্ববর্তী বিক্রি করা সব পণ্যের দামও কমে যায়। এই দাম কমার কারণে যে ক্ষতি হয়, তা নতুন ইউনিটের বিক্রয় থেকে প্রাপ্ত আয়ের একটি অংশ খেয়ে ফেলে, ফলে প্রান্তিক আয় তার দামের চেয়ে কম হয়ে যায়।
৪। গড় আয় রেখা: একচেটিয়া বাজারে, গড় আয় রেখা একটি নিম্নগামী রেখা হয়। এই রেখাটিই মূলত বাজারের চাহিদা রেখা। এর কারণ হলো, একচেটিয়া কারবারি যদি বেশি পণ্য বিক্রি করতে চায়, তবে তাকে অবশ্যই পণ্যের দাম কমাতে হবে। ফলে, বিক্রি বাড়লে গড় আয় কমতে থাকে এবং এই সম্পর্কটি একটি নিম্নগামী রেখা দ্বারা প্রকাশ করা হয়।
৫। প্রান্তিক আয় রেখা: একচেটিয়া কারবারের ক্ষেত্রে, প্রান্তিক আয় রেখাও একটি নিম্নগামী রেখা হয়। তবে এটি গড় আয় রেখার নিচে অবস্থান করে এবং এর ঢাল গড় আয় রেখার ঢালের চেয়ে বেশি হয়। প্রান্তিক আয় রেখা গড় আয় রেখার নিচে থাকার মূল কারণ হলো, অতিরিক্ত ইউনিট বিক্রির জন্য দাম কমালে তা মোট আয়কে কম হারে বাড়ায়, যার ফলে প্রান্তিক আয় গড় আয়ের তুলনায় দ্রুত হ্রাস পায়।
৬। গড় আয় > প্রান্তিক আয়: একচেটিয়া কারবারিতে গড় আয় সর্বদা প্রান্তিক আয়ের চেয়ে বেশি হয়। এটি এই বাজারের একটি মৌলিক বৈশিষ্ট্য। যখন একজন বিক্রেতা আরও বেশি পণ্য বিক্রি করতে চায়, তখন তাকে দাম কমাতে হয়। এই দাম কমার প্রভাব সমস্ত পণ্যের উপর পড়ায়, অতিরিক্ত ইউনিট থেকে প্রাপ্ত আয় পূর্ববর্তী ইউনিটগুলোর দাম কমার ফলে সৃষ্ট ক্ষতিকে পুরোপুরি পূরণ করতে পারে না, তাই প্রান্তিক আয় গড় আয় থেকে কম হয়।
৭। মুনাফা সর্বোচ্চকরণ: একজন একচেটিয়া কারবারি তার মুনাফা সর্বোচ্চ করতে চায়। এই উদ্দেশ্য অর্জনের জন্য সে এমন একটি উৎপাদন স্তর নির্ধারণ করে যেখানে প্রান্তিক আয় (MR) এবং প্রান্তিক ব্যয় (MC) সমান হয়। এই অবস্থায় সে সর্বোচ্চ মুনাফা লাভ করে। এই বিন্দুতে গড় আয় এবং প্রান্তিক আয়ের মধ্যে পার্থক্য যত বেশি হবে, মুনাফার সম্ভাবনা তত বেশি হবে।
৮। সম্পর্ক বিশ্লেষণ: গড় আয় এবং প্রান্তিক আয়ের মধ্যে সম্পর্কটি একটি নির্দিষ্ট রেখাচিত্রের মাধ্যমে স্পষ্টভাবে দেখানো যায়। দুটি রেখাই বাম থেকে ডান দিকে নিম্নগামী হয়, কিন্তু প্রান্তিক আয় রেখা সর্বদা গড় আয় রেখার নিচে থাকে। এই সম্পর্কের কারণ হলো, দাম কমার সঙ্গে সঙ্গে গড় আয় ও প্রান্তিক আয় উভয়ই হ্রাস পায়, তবে প্রান্তিক আয় দ্রুততর গতিতে হ্রাস পায়।
৯। দাম ও উৎপাদন: একচেটিয়া কারবারি তার পণ্যের দাম এবং উৎপাদন পরিমাণ উভয়ই নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। কিন্তু তাকে মুনাফা সর্বোচ্চকরণের জন্য এমনভাবে দাম নির্ধারণ করতে হয় যেন প্রান্তিক আয় ও প্রান্তিক ব্যয় সমান হয়। এই কারণে একচেটিয়া কারবারি দাম নির্ধারণের সময় তার গড় আয় ও প্রান্তিক আয়ের মধ্যকার সম্পর্ককে বিবেচনায় রাখে, যা তাকে বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে সাহায্য করে।
উপসংহার: একচেটিয়া কারবারের ক্ষেত্রে গড় আয় এবং প্রান্তিক আয়ের মধ্যে সম্পর্ক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই দুটি ধারণার সঠিক বিশ্লেষণ একজন বিক্রেতাকে তার পণ্যের দাম নির্ধারণ ও মুনাফা সর্বোচ্চকরণে সহায়তা করে। গড় আয় রেখাটি বাজারের চাহিদা রেখা হিসেবে কাজ করে, অন্যদিকে প্রান্তিক আয় রেখা মোট আয়ের পরিবর্তন নির্দেশ করে। এই সম্পর্কটি বোঝা একজন একচেটিয়া কারবারির জন্য বাজারের গতিবিধি সঠিকভাবে বোঝার চাবিকাঠি।
- 🔹গড় আয় ও দাম
- 🔹প্রান্তিক আয়
- 🔹প্রান্তিক আয় বনাম দাম
- 🔹গড় আয় রেখা
- 🔹প্রান্তিক আয় রেখা
- 🔹গড় আয় > প্রান্তিক আয়
- 🔹মুনাফা সর্বোচ্চকরণ
- 🔹সম্পর্ক বিশ্লেষণ
- 🔹দাম ও উৎপাদন
১৯৩২ সালে ব্রিটিশ অর্থনীতিবিদ জোয়ান রবিনসন তার “The Economics of Imperfect Competition” বইয়ে একচেটিয়া কারবার ও এর গড় আয়-প্রান্তিক আয়ের সম্পর্ক নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেন, যা এই ধারণাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়। তার কাজ দেখায় যে, অপ্রতিযোগিতামূলক বাজারে দাম নির্ধারণের কৌশল কীভাবে ভিন্ন হয়। পরবর্তীকালে, বিভিন্ন জরিপে দেখা যায় যে, প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন এবং পেটেন্ট অধিকার একচেটিয়া ক্ষমতাকে আরও শক্তিশালী করেছে, যা বাজারে দাম ও সরবরাহের ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলে।

