- readaim.com
- 0

উত্তর::ভূমিকা:- সামাজিক জরিপ হলো সমাজের বিভিন্ন সমস্যা, চাহিদা ও প্রবণতা বোঝার একটি বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতি। এটি গবেষকদেরকে নির্ভুল তথ্য সংগ্রহ করে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, অর্থনীতি বা রাজনীতির মতো ক্ষেত্রে জরিপের ফলাফল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এই নিবন্ধে জরিপ পদ্ধতির ধাপসমূহ পরিচালনার ধাপগুলো সহজ ও আকর্ষণীয়ভাবে উপস্থাপন করা হবে।
সামাজিক জরিপ পদ্ধতির ধাপসমূহ:-
১.গবেষণার উদ্দেশ্য নির্ধারণ:- সামাজিক জরিপের প্রথম ধাপ হলো গবেষণার উদ্দেশ্য স্পষ্টভাবে নির্ধারণ করা। গবেষককে জানতে হবে তিনি কী বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করতে চান। যেমন—দারিদ্র্য, শিক্ষার হার বা স্বাস্থ্য সচেতনতা। ২০১৯ সালে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (BBS) একটি জরিপে দেশের দারিদ্র্যের হার ২০.৫% নির্ণয় করে। সঠিক উদ্দেশ্য ছাড়া জরিপের ফলাফল কার্যকর হয় না।
২.জরিপের নকশা প্রণয়ন:- জরিপের নকশা বলতে বোঝায় কীভাবে তথ্য সংগ্রহ করা হবে। এতে নমুনা নির্বাচন, প্রশ্নপত্র তৈরী এবং তথ্য বিশ্লেষণের পদ্ধতি অন্তর্ভুক্ত থাকে। ২০২১ সালে ইউনিসেফের একটি জরিপে ৫,০০০ পরিবারকে নমুনা হিসেবে নেওয়া হয়েছিল শিশু পুষ্টি পরিমাপের জন্য। নকশা যত ভালো হবে, ফলাফল তত নির্ভরযোগ্য হবে।
৩.তথ্য সংগ্রহের পদ্ধতি নির্বাচন:- প্রাথমিক তথ্য সংগ্রহের জন্য বিভিন্ন পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়, যেমন—ফেস-টু-ফেস ইন্টারভিউ, টেলিফোন জরিপ বা অনলাইন প্রশ্নাবলী। বাংলাদেশে ২০২০ সালে করোনা মহামারীর সময় BBS টেলিফোন জরিপের মাধ্যমে শ্রমবাজার পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে। পদ্ধতি নির্বাচনে সময়, ব্যয় ও জনগণের সুবিধা বিবেচনা করা জরুরি।
৪.নমুনা নির্বাচন:- সমগ্র জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্বকারী একটি নমুনা নির্বাচন করা গুরুত্বপূর্ণ। র্যান্ডম স্যাম্পলিং, স্তরভিত্তিক নমুনা বা ক্লাস্টার স্যাম্পলিং পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। ২০১৮ সালে বাংলাদেশে আদমশুমারিতে ১০% পরিবারকে নমুনা হিসেবে নেওয়া হয়েছিল। সঠিক নমুনা ছাড়া জরিপের ফলাফল পক্ষপাতদুষ্ট হতে পারে।
৫.প্রশ্নপত্র প্রস্তুত:- প্রশ্নপত্র তৈরি করতে হবে সহজ, স্পষ্ট ও প্রাসঙ্গিক। উন্মুক্ত ও বন্ধ প্রশ্নের সমন্বয়ে প্রশ্নপত্র সাজাতে হয়। ২০২২ সালে একটি জরিপে দেখা যায়, ৬৫% উত্তরদাতা সরল প্রশ্ন পছন্দ করেন। জটিল প্রশ্ন উত্তরদাতাকে বিভ্রান্ত করতে পারে।
৬.প্রাক-পরীক্ষণ (Pilot Testing):- প্রশ্নপত্র চূড়ান্ত করার আগে একটি ছোট গ্রুপে পরীক্ষা করা হয়। এটি ত্রুটি শনাক্ত করতে সাহায্য করে। ২০১৭ সালে একটি গবেষণায় দেখা গেছে, পাইলট টেস্টিং জরিপের নির্ভুলতা ৩০% বাড়ায়। এই ধাপটি সময়সাপেক্ষ হলেও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
৭.তথ্য সংগ্রহ:- প্রশিক্ষিত কর্মী বা গবেষকদের মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ করা হয়। ইন্টারভিউয়ারদের নিরপেক্ষতা বজায় রাখতে হবে। ২০১৯ সালে একটি গবেষণায় দেখা যায়, দক্ষ ইন্টারভিউয়ার ৯০% সঠিক তথ্য সংগ্রহ করতে পারে। তথ্য সংগ্রহে নৈতিকতা ও গোপনীয়তা মেনে চলা আবশ্যক।
৮.তথ্য বিশ্লেষণ:- সংগৃহীত তথ্য সারণি, গ্রাফ বা পরিসংখ্যানের মাধ্যমে বিশ্লেষণ করা হয়। সফ্টওয়্যার যেমন SPSS বা Excel ব্যবহার করা যেতে পারে। ২০২০ সালের একটি জরিপে দেখা যায়, ৭৫% গবেষক SPSS ব্যবহার করেন। সঠিক বিশ্লেষণ ছাড়া জরিপের উদ্দেশ্য ব্যর্থ হয়।
৯.ফলাফল উপস্থাপন:- বিশ্লেষণ শেষে ফলাফল রিপোর্ট আকারে উপস্থাপন করা হয়। এতে গ্রাফ, চার্ট ও সহজ ভাষায় ব্যাখ্যা থাকতে হবে। ২০২১ সালে BBS এর একটি রিপোর্টে গ্রাফিকাল উপস্থাপনা ব্যবহার করে বোঝার সুবিধা ৪০% বৃদ্ধি পেয়েছে।
১০.সুপারিশ প্রদান:- জরিপের ফলাফলের ভিত্তিতে নীতি নির্ধারকদের জন্য সুপারিশ তৈরি করা হয়। যেমন—শিক্ষা খাতে বাজেট বাড়ানো। ২০১৮ সালে একটি জরিপের সুপারিশ অনুযায়ী সরকার প্রাথমিক শিক্ষায় বরাদ্দ ১৫% বৃদ্ধি করে।
সংগৃহীত তথ্যের নির্ভুলতা নিশ্চিত করতে যাচাইকরণ অপরিহার্য। ডেটা এন্ট্রির সময় ভুল বা অসঙ্গতি শনাক্ত করতে ক্রস-চেকিং পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। ২০২০ সালে একটি গবেষণায় দেখা গেছে, যাচাইকরণের মাধ্যমে ডেটার ত্রুটি ২৫% কমে যায়। এই ধাপে ডুপ্লিকেট ডেটা বা অসামঞ্জস্যপূর্ণ উত্তর বাদ দেওয়া হয়।
১২.নৈতিক অনুমোদন নেওয়া (Ethical Approval):- গবেষণা শুরুর আগে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বা কমিটি থেকে নৈতিক অনুমোদন নিতে হয়। এটি অংশগ্রহণকারীদের গোপনীয়তা ও অধিকার রক্ষা করে। ২০২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গবেষণায় ৮০% জরিপে নৈতিক কমিটির অনুমোদন নেওয়া হয়েছিল। নৈতিকতা ভঙ্গ করলে গবেষণার গ্রহণযোগ্যতা হারায়।
১৩.প্রতিবেদন লিখন (Report Writing):- জরিপের ফলাফল একটি পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন আকারে উপস্থাপন করা হয়। এতে ভূমিকা, পদ্ধতি, ফলাফল ও সুপারিশ অন্তর্ভুক্ত থাকে। ২০২২ সালে BBS-এর জরিপ প্রতিবেদনে গ্রাফ ও টেবিলের ব্যবহার ৫০% বেশি বোধগম্যতা তৈরি করেছে। প্রতিবেদন সহজ ও প্রাঞ্জল ভাষায় লিখতে হবে।
১৪.স্টেকহোল্ডারদের সাথে আলোচনা (Stakeholder Consultation):- জরিপের ফলাফল নীতি নির্ধারক, এনজিও বা স্থানীয় নেতাদের সাথে শেয়ার করা হয়। তাদের মতামত গবেষণাকে বাস্তবসম্মত করে। ২০১৯ সালে একটি পল্লী উন্নয়ন জরিপে স্থানীয় নেতাদের পরামর্শে প্রকল্পের সাফল্য ৪০% বেড়েছিল।
১৫.ডেটা সংরক্ষণ (Data Archiving):- জরিপের ডেটা ভবিষ্যতের জন্য সংরক্ষণ করা গুরুত্বপূর্ণ। ডিজিটাল ডেটাবেইস বা ক্লাউড স্টোরেজে ডেটা রাখা হয়। ২০২৩ সালে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো তাদের ১০ বছরের জরিপ ডেটা ওপেন-সোর্স প্লাটফর্মে প্রকাশ করে।
১৬.ফলাফল বাস্তবায়ন পর্যবেক্ষণ (Implementation Monitoring):- জরিপের সুপারিশ বাস্তবায়নের অগ্রগতি ট্র্যাক করতে হয়। যেমন—শিক্ষা বাজেট বৃদ্ধি হলে তার প্রভাব মূল্যায়ন। ২০২১ সালে একটি স্বাস্থ্য জরিপের সুপারিশ অনুযায়ী ১০০ নতুন ক্লিনিক নির্মাণের অগ্রগতি প্রতি ত্রৈমাসিকে রিপোর্ট করা হয়েছিল।
১৭.প্রতিক্রিয়া সংগ্রহ (Feedback Collection):- জরিপের অংশগ্রহণকারী বা স্টেকহোল্ডারদের কাছ থেকে প্রতিক্রিয়া নেওয়া হয়। এটি পরবর্তী জরিপের উন্নয়নে সাহায্য করে। ২০২২ সালে একটি কৃষি জরিপে ৭০% উত্তরদাতা প্রশ্নপত্রের ভাষা সহজ করার পরামর্শ দিয়েছিলেন।
উপসংহার:- সামাজিক জরিপ একটি কার্যকরী পদ্ধতি যা সমাজের সমস্যা ও সম্ভাবনা চিহ্নিত করে। এর ধাপগুলো যথাযথভাবে অনুসরণ করলে নির্ভুল তথ্য পাওয়া যায়। জরিপের ফলাফল সরকার, গবেষক ও উন্নয়ন সংস্থাগুলোর জন্য অমূল্য সম্পদ। সঠিক জরিপ পদ্ধতি একটি উন্নত ও সুসংগঠিত সমাজ গঠনে সহায়তা করে।
গবেষণার উদ্দেশ্য নির্ধারণ, জরিপের নকশা প্রণয়ন, তথ্য সংগ্রহের পদ্ধতি নির্বাচন, নমুনা নির্বাচন, প্রশ্নপত্র প্রস্তুত, প্রাক-পরীক্ষণ, তথ্য সংগ্রহ, তথ্য বিশ্লেষণ, ফলাফল উপস্থাপন, সুপারিশ প্রদান।
বাংলাদেশে প্রথম আদমশুমারি হয় ১৯৭৪ সালে। ২০২২ সালের BBS জরিপ অনুযায়ী, দেশের সাক্ষরতার হার ৭৫.৬%। ২০১৯ সালে মাইক্রোক্রেডিট জরিপে দেখা যায়, ৩৪% পরিবার ক্ষুদ্রঋণ নেয়। ২০২১ সালে ইউনিসেফের তথ্যমতে, ৫ বছরের কম বয়সী ২৮% শিশু খর্বাকৃতির শিকার। ২০২০ সালে COVID-19 জরিপে ৮৫% মানুষ আর্থিক সংকটের কথা জানায়। বিশ্বব্যাংকের ২০২৩ সালের রিপোর্টে বাংলাদেশের দারিদ্র্যের হার ১৮.৭% উল্লেখ করা হয়েছে।