- readaim.com
- 0
উত্তর::ভূমিকা: আমরা যখন বাজারে কোনো কিছু কিনতে যাই, তখন প্রায়শই এমন হয় যে, কোনো পণ্যের জন্য আমরা যতটা দাম দিতে ইচ্ছুক, তার চেয়ে কম দামে পণ্যটি কিনতে পারি। এই কম দামে পণ্যটি কেনার ফলে আমাদের মনে এক ধরনের সন্তুষ্টি বা লাভ হয়। অর্থনীতির এই বিশেষ ধারণাটিই হলো ভোক্তার উদ্বৃত্ত। এটি কোনো একটি পণ্য ক্রয়ের ক্ষেত্রে একজন ভোক্তার ব্যক্তিগত সন্তুষ্টির পরিমাপক, যা তার বাজেট ও বাজারমূল্যের মধ্যেকার পার্থক্য থেকে উদ্ভূত হয়।
ভোক্তার উদ্বৃত্ত – শাব্দিক অর্থ ও পরিচয়:-
ভোক্তার উদ্বৃত্ত হলো একজন ভোক্তা কোনো পণ্যের জন্য যে সর্বোচ্চ মূল্য দিতে প্রস্তুত থাকে, সেই মূল্য এবং বাস্তবে তাকে যে মূল্য দিতে হয়, তার মধ্যেকার পার্থক্য। সহজভাবে বলতে গেলে, এটি হলো ক্রেতার সাশ্রয় বা অতিরিক্ত সন্তুষ্টি, যা সে বাজারমূল্যের চেয়ে কম দামে পণ্যটি পাওয়ার ফলে অনুভব করে। এটি একটি অর্থনৈতিক ধারণা যা ভোক্তার কল্যাণ বা লাভকে নির্দেশ করে।
আলফ্রেড মার্শাল (Alfred Marshall) বলেন, “কোনো দ্রব্যের জন্য একজন ক্রেতা যে মূল্য দিতে রাজি থাকে এবং সে যে মূল্য আসলে প্রদান করে, তাদের পার্থক্যই হলো ভোক্তার উদ্বৃত্ত।” স্যামুয়েলসন (Paul Samuelson) এর মতে, “কোনো ব্যক্তি একটি দ্রব্যের জন্য যে অতিরিক্ত অর্থ প্রদান করতে প্রস্তুত থাকে, তার তুলনায় যে পরিমাণ অর্থ তাকে প্রকৃতপক্ষে দিতে হয়, তার পার্থক্যই হলো ভোক্তার উদ্বৃত্ত।”
ভোক্তার উদ্বৃত্ত ধারণার গুরুত্ব:-
১। ভোক্তার কল্যাণ পরিমাপ: ভোক্তার উদ্বৃত্তের মাধ্যমে বাজারে ভোক্তারা কতটা লাভবান হচ্ছে বা তাদের কল্যাণ কতটা বাড়ছে, তা পরিমাপ করা যায়।
২। সরকারি নীতি নির্ধারণ: সরকার যখন কোনো পণ্যের উপর কর আরোপ করে, তখন পণ্যের দাম বেড়ে যায় এবং ভোক্তার উদ্বৃত্ত কমে যায়। এই ধারণাটি কর নীতির প্রভাব মূল্যায়নে সহায়তা করে।
৩। ব্যবসায়িক সিদ্ধান্ত: ব্যবসায়ীরা মূল্য নির্ধারণের ক্ষেত্রে ভোক্তার উদ্বৃত্ত ধারণাটি ব্যবহার করে সর্বোচ্চ মুনাফা অর্জনের কৌশল নির্ধারণ করতে পারে।
উপসংহার: ভোক্তার উদ্বৃত্ত নির্দেশ করে যে বাজারে কেনাকাটা থেকে ভোক্তারা কতটা সুবিধা পায়। এটি অর্থনৈতিক কার্যকারিতা ও বাজারের সামঞ্জস্য বোঝার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। যখন মূল্য কমে, উদ্বৃত্ত বাড়ে, যা ভোক্তাদের জন্য উপকারী। তবে, এটি উৎপাদকের উদ্বৃত্তের সঙ্গে সন্তुलন রক্ষা করাই বাজারের স্থিতিশীলতার জন্য প্রয়োজন।
ভোক্তার উদ্বৃত্ত ধারণা এর সমালোচনা:- ভোক্তার উদ্বৃত্ত ধারণাটির কিছু সীমাবদ্ধতা বা সমালোচনা রয়েছে। এর প্রধান সমালোচনাগুলো হলো-
১। ব্যক্তিগত ভিন্নতা: প্রতিটি ভোক্তার পছন্দ, রুচি এবং আর্থিক অবস্থা ভিন্ন। এই ধারণাটি ধরে নেয় যে সকল ভোক্তার জন্য একটি পণ্যের উপযোগিতা একই, যা বাস্তবে সত্যি নয়।
২। অর্থ-উপযোগিতার পরিবর্তনশীলতা: এই ধারণাটি অর্থের প্রান্তিক উপযোগিতাকে স্থির বলে ধরে নেয়। কিন্তু একজন ধনী ব্যক্তির কাছে এক টাকার যে উপযোগিতা, একজন দরিদ্র ব্যক্তির কাছে তা অনেক বেশি। ফলে অর্থের উপযোগিতা স্থির নয়।
৩। বিকল্পের অভাব: এটি এমন কিছু পণ্যের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়, যার কোনো বিকল্প নেই। যেমন – লবণ, ঔষধ ইত্যাদি। এক্ষেত্রে ভোক্তা উদ্বৃত্ত পরিমাপ করা কঠিন।
৪। অনুমাননির্ভর: ভোক্তার সর্বোচ্চ প্রদেয় মূল্য পরিমাপ করা অত্যন্ত কঠিন এবং এটি কেবল অনুমানের উপর নির্ভরশীল।
৫। ব্যবহারিক প্রয়োগের সীমাবদ্ধতা: কিছু পণ্য যেমন বিলাসবহুল দ্রব্য বা যৌথভাবে ব্যবহৃত দ্রব্যের ক্ষেত্রে ভোক্তার উদ্বৃত্ত পরিমাপ করা প্রায় অসম্ভব।
ধরা যাক, একজন ভোক্তা আপেল কিনবে এবং প্রতিটি আপেলের বাজার দর ১০ টাকা। বিভিন্ন আপেলের জন্য তার দিতে ইচ্ছুক দাম নিচে দেওয়া হলো:-

উপরের সারণি থেকে দেখা যাচ্ছে, ভোক্তা প্রথম ৪টি আপেল থেকে উদ্বৃত্ত পাচ্ছে কারণ তার দিতে ইচ্ছুক দাম বাজার দামের চেয়ে বেশি। ৫ম আপেলে এসে তার দিতে ইচ্ছুক দাম এবং বাজার দাম সমান হওয়ায় কোনো উদ্বৃত্ত নেই। সুতরাং, এই ক্ষেত্রে ভোক্তার মোট উদ্বৃত্ত হলো (২০ + ১৫ + ১০ + ৫) = ৫০ টাকা।

চিত্রটি “ভোক্তার উদ্বৃত্ত” (Consumer Surplus) দেখাচ্ছে, যা অর্থনীতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ ধারণা। এখানে, X অক্ষে পণ্যের পরিমাণ (Quantity) এবং Y অক্ষে মূল্য (Price) দেখানো হয়েছে। D লাইনটি চাহিদা বক্র (Demand Curve) নির্দেশ করে, যা মূল্য কমলে পরিমাণ বাড়ে। P বিন্দুতে বাজার মূল্য এবং Q পরিমাণ নির্ধারিত হয়। ভোক্তার উদ্বৃত্ত হলো K, P, Q এবং D দ্বারা গঠিত নীল ছায়াযুক্ত এলাকা। এটি নির্দেশ করে যে ভোক্তারা যে মূল্য দিয়েছে (P) তার চেয়ে বেশি মূল্যে (D) পণ্যের জন্য প্রস্তুত ছিলেন, এবং এই পার্থক্যই তাদের উদ্বৃত্ত।

